ড. ইউনূস সরকারের মেয়াদ দুই মাস হতে যাচ্ছে। গত দুই মাসের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর রাজনৈতিক বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ যা যা ধারণা করেছিলেন, মোটামুটি সেগুলোই ঘটছে। কিন্তু এরই মধ্যে ঘটে যাওয়া দুটো সুনির্দিষ্ট ঘটনা ঠিক প্রচলিত ধারার মধ্যে পড়ছে না। ঘটনা ও তার ফলাফলের মধ্যবর্তী দূরত্ব একটু বেশি বলেই হয়ত এটা তেমন ঘেঁটে দেখা হয়নি। দুটো ঘটনার মধ্যে একটি ঘটনা নিয়ে আজকের লেখাটি। জুলাইয়ের সরকার পতন আন্দোলনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডার শিক্ষক নেটওয়ার্ক কেন ইউনূস সরকারের টার্গেটে পরিণত হলো? এর কারণ কি?
প্রথমেই ঘটনাপূর্ব ঘটনার একটা রিকেপ দেই। ৫ তারিখে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বললেন, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশত্যাগ করেছেন। তবে প্রধানমন্ত্রী কার কাছে পদত্যাগ করেছেন, সে কথা তিনি নিজের মুখে বলেননি। একবারও না। সংবিধানের চতুর্থ ভাগের (নির্বাহী বিভাগ) ২য় পরিচ্ছেদভুক্ত (প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভা) ধারা ৫৭ এর (প্রধানমন্ত্রীর পদের মেয়াদ) ১ (ক, খ) ও ২ অনুচ্ছেদে বলা আছে প্রধানমন্ত্রীর পদ কখন শূন্য হবে। এই ধারা মতে, প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রপতির কাছেই পদত্যাগপত্র প্রদান করতে হবে (সূত্র:সংবিধানের স্ক্রিনশট কমেন্টে)। পদত্যাগের অন্য কোনো পথ নেই।
এখন ৬ তারিখের পত্রিকাগুলো ফলাও করে পদত্যাগের সংবাদ প্রচার করেছে। কিন্তু একটু মনোযোগ দিয়ে পত্রিকাগুলো পড়লে দেখবেন, প্রধানমন্ত্রী যে “রাষ্ট্রপতির কাছে” পদত্যাগ করেছেন, এ কথা কোনো পত্রিকাই তাদের নিজস্ব প্রতিবেদনে লেখেনি। সবাই তথ্যটি দিয়েছে রাষ্ট্রপতির বরাতে, বাসসের পাঠানো রাষ্ট্রপতির ভাষণের রিপোর্টের সূত্রে। অর্থাৎ বক্তব্যের দায় রাষ্ট্রপতির, যেহেতু তিনি ভাষণ দিয়েছেন; তথ্যের দায় বঙ্গভবনের, যেহেতু তারা প্রেসবিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছে আর সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের দায় বাসসের, যেহেতু তারা সংবাদ সংস্থা। বাকিরা কেবল ‘চালাই’ দিছেন। (সূত্র: দ্য ডেইলি স্টারের নিউজ)
কিন্তু সবাই তো আর ‘চালাই’ দিতে পারেন না। ৬ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মিছিল সহযোগে একটি সংবাদ সম্মেলন করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। আন্দোলনে তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সংগঠনটির ৬ আগস্টের মিছিলটিও ইতিহাসের বিচারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর থেকেই দেশজুড়ে যে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস, লুটপাট, রাজনৈতিক সহিংসতা শুরু হয়েছিল এবং কোনো গণমাধ্যমেই যে এ সংবাদগুলো আসেনি শিক্ষকদের এ সংগঠনটি তার কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছিল।
সূত্রে দেওয়া ইত্তেফাকের ডিজিটাল রিপোর্টের শিরোনামটি লক্ষ্য করুন, “কোন ক্ষমতাবলে আইএসপিআর সব খোলার নির্দেশ দিল: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক”। অত্যন্ত যৌক্তিক ও সাহসী জিজ্ঞাসা। সভায় চারজন শিক্ষক লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন, যদিও পুরো প্রতিবেদনে কোনো শিক্ষকেরই নাম নেই।
লিখিত বক্তব্যের এক পর্যায়ে তারা আমাদের একটি চমকপ্রদ তথ্য দেন। শিক্ষকরা বলেন, “উল্লেখ্য প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদের স্পিকারের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে…”। লক্ষ্য করুন, শেখ হাসিনার পদত্যাগের বিষয়ে একমাত্র তথ্য, যেটা আর কেউ বলেনি। যে সময় তারা সংবাদ সম্মেলনটি করেছেন, তারও ১২ ঘণ্টা আগে থেকে সারাদেশের সকল মিডিয়া দেখাচ্ছে, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তারা জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী স্পিকারের কাছে পদত্যাগপত্র দিয়েছেন, যদিও সংবিধানে সে সুযোগ নেই। এমনকি সংবিধানের পঞ্চম ভাগের (আইনসভা) ১ম পরিচ্ছেদভুক্ত (সংসদ) স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার অংশে দেখা যাচ্ছে, এ দুজনকেও পদত্যাগ করতে হলে রাষ্ট্রপতির কাছেই পদত্যাগপত্র দিতে হবে।
এখানেই শেষ নয়, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক যে ৫টি বিষয়ে সেদিন উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল, তার মধ্যে ১ নম্বর উদ্বেগটিই ছিল শাসনতন্ত্র বিষয়ে। তারা প্রশ্ন রেখেছিলেন, দেশ কার শাসনে কোন বিধি অনুযায়ী চলছে? সেনাপ্রধানের, নাকি প্রেসিডেন্টের, নাকি স্পিকারের তত্ত্বাবধানে মন্ত্রীসভার অধীনে? অর্থাৎ এখানেও কিন্তু তারা স্পিকারের বিষয়টি নিয়ে অনড়, যদিও সংবিধান মতে, এ সুযোগটিও নেই।
এখন প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রপতির কাছে যদি পদত্যাগ করে থাকেন আর রাষ্ট্রপতি যদি তা গ্রহণ করেন, তবে প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের দাবি অনুযায়ী, স্পিকারের কাছে পদত্যাগপত্র দিলে তার কোনো মূল্যই কিন্তু নেই। এমনকি রাষ্ট্রপতির পক্ষেও তা গ্রহণ করা সম্ভব নয়, যেহেতু প্রধানমন্ত্রী তাকে পদত্যাগপত্র দেননি। তখন এই সরকারের দাবিকৃত সবই মিথ্যা হয়ে যায়।
এখন শিক্ষক নেটওয়ার্কের এ দাবির পর, ৬ আগস্টেই প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ বিষয়ে সন্দেহ শুরু হয়। নানা পক্ষ থেকে পদত্যাগপত্রটি পাবলিক করার দাবি ওঠে। ইউনূস প্রশাসনও আওয়ামী লীগের কোন এমপি কোন চালের ভাত খেত, সে তথ্য দিতে পারলেও, পদত্যাগপত্রটি দেখাতে পারছে না দু মাস ধরে। উল্টো ফটোশপ করতে গিয়ে লোক হাসিয়েছে। মানে ওয়াকার ইউনূস সরকারের হাতে নাটকের যে চিত্রনাট্যটি ছিল, শিক্ষক নেটওয়ার্ক হঠাৎ করেই ৬ আগস্ট সকালে তার বাইরে সংলাপ দেওয়া শুরু করে দেয়। আর তাতেই বিপত্তিতে পড়ে এই নাটকের প্রযোজক নির্দেশকরা।
তবে এই বল মাঠে বেশিক্ষণ ছিল না, কারণ দ্রুতই ড. ইউনূস শপথ নেন এবং সেনা-সমর্থিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গড়ে তুলেন। কিন্তু অতীতের ধারাবাহিকতায় ৬ আগস্ট যে সাহসিকতার পরিচয় রেখেছিল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক ওয়াকার ইউনূস সরকার কিন্তু তা বরদাশত করেনি। পাখি যেহেতু তার ডানার ওপর বিশ্বাস রেখেই ওড়ে, তাই ওড়া বন্ধ করতে হলে পাখির ডানা কাটতে হবে। কিন্তু ড. ইউনূস তো নোবেলবিজয়ী, তাও আবার শান্তিতে। তাই অং সান সু চি’র মতো তিনিও কেবল অ্যানেসথেসিয়া দেন, কাটাকাটি করার দায়িত্ব সার্জনের।
আবার লেখক-সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরকে যেভাবে টাইট দেওয়া হচ্ছে, এই শিক্ষকদের ক্ষেত্রে সেটাও সম্ভব নয়। ফলে অনেক ভেবেচিন্তে এক পবিত্র শুক্কুরবারে সরকার তাদের বিরুদ্ধে মৌলবাদের ট্রাম্পকার্ডটি ব্যবহার করল। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের গুরুত্বপূর্ণ দুজন সদস্য ড. সামিনা লুৎফা ও ড. কামরুল হাসান মামুনের বিরুদ্ধে উগ্র জঙ্গীবাদীরা তথাকথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে তাদের পাঠ্যপুস্তক সংশোধন কমিটি থেকে বাদ দেওয়ার দাবি জানাল আর আমাদের শিক্ষা উপদেষ্টা বাপের সুপুত্তরের মতো সুড়সুড় করে সে দাবি মেনে নিল।
এরপর গত কয়েক সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের কাজগুলো লক্ষ্য করুন। যে সাহস তারা ৬ আগস্ট দেখাতে পেরেছিলেন, এখন নিজেদের বিষয়েও সংগঠনটি প্রতিবাদের সে সাহস দেখাতে পারছেন না। জোর গলায় শিক্ষা উপদেষ্টাকে প্রশ্ন করতে পারছেন না, কেন এভাবে শিক্ষকদের অপমান করা হলো? কেন মৌলবাদের ভয়ে কমিটি ভেঙে দেওয়া হলো? উল্টো নিজেরাই স্বগোতোক্তি করছেন, “দেখেন যা ভালো মনে করেন।”
পাহাড়ে আদিবাসীদের ওপর নির্যাতন, ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর চলমান নির্যাতন, ড. ইউনূস সরকারের নির্বিচার শ্রমিকহত্যা, দেশজুড়ে সংঘটিত বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, বাজারে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস উঠে যাওয়া সাধারণ মানুষের কষ্টের জীবন… এগুলো নিয়ে আমাদের শিক্ষক নেটওয়ার্কের সদস্যরা আর সোচ্চার থাকতে পারছেন না বা প্রয়োজন বোধ করছেন না। কারণ তাদের নিজেদের জীবনই আজ জঙ্গীদের নিলামে উঠিয়ে দিয়েছে সরকার। ফলে, রাজপথের মিছিল-প্রতিবাদ এখন নখদন্তহীন সেমিনারে এসে ঠেকেছে। সংগঠনের নেতাদের কেউ কেউ অবশ্য শকুন্তলার হরিণশিশুর মতো কাতর নয়নে কালিদাসের ভাষায় সরকারকে দুয়েকটি ছবক দেওয়ার চেষ্টা করছেন, তবে সেটাও খুব ভেবেচিন্তে, শব্দে বাক্যে নবপরিণীতার মিষ্টি লজ্জা নিয়ে।
৬ আগস্ট যে সংগঠনটি সাহসের সাথে সেনাবাহিনীকে অত্যন্ত যৌক্তিক প্রশ্ন করেছিল, যারা শেখ হাসিনার পদত্যাগের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি জনগণকে জানিয়েছিল, আজ তাদের হোর্ডিং হয়ে গেছে, ডোন্ট ডিস্টার্ব ইউনূস পলিসি। তবে কি শেখ হাসিনার পদত্যাগের প্রশ্নে বঙ্গভবনের প্রেসনোট না মেনে বিবৃতি দেওয়া আর সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিষয়ে সেনাবাহিনীকে কঠোর ভাষায় সমালোচনার জন্যই ওয়াকার ইউনূস সরকারের গুডবুক থেকে ছিটকে পড়লো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক?
#ATeam 20241020