সংস্কার কি শুধু করমুক্তি? শুধুই আখের গোছানো?


সংস্কার কি শুধু করমুক্তি? শুধুই আখের গোছানো?

১.
গতকালের খবর, ৪ বছর পর আবারো আয়করমুক্ত হলো গ্রামীণ ব্যাঙ্ক। ফেইক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সব সরকারই দীর্ঘদিন যাবত গ্রামীণ ব্যাঙ্ককে করের আওতার বাইরে রেখেছিলো। এটি একটি অন্যায় সুবিধা। অন্যান্য ব্যাঙ্কের তুলনায় গ্রামীণকে যা একটি আর্থিক ও স্ট্রাটেজিক অ্যাডভান্টেজ দেয়। ড. ইউনূসের ব্যবসায়িক নয়-ছয়ের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গ্রামীণের ভূমিকা অনেক। এখন তো সেটি ব্যবসাকে ছাপিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।

গ্রামীণ ব্যাঙ্ক অলাভজনক নয়। গ্রামীণ ব্যাঙ্ক দাতব্য সংস্থা নয়। গ্রামীণ ব্যাঙ্ক গরীবের বন্ধু নয়। এই লেখায় তাত্ত্বিক আলোচনায় যাবো না। কিন্তু গ্রামীণের লোনের বিপরীতে গ্রহীতা – যাদেরকে আবার নিষ্ঠুরভাবে মজা করে গ্রামীণ ব্যাঙ্কের মালিকও বলা হয় – তাদের ঘরের চাল খুলে নেয়া এবং গ্রামীণের আর্থিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা আমলে নিলেই বিষয়টি জলের মতো পরিষ্কার। ড. ইউনূসের ক্ষুদ্র ঋণ দারিদ্র‍্য বিমোচন করে না, দরিদ্র মানুষ তাদের ব্যবসায়ের উপকরণ, ব্যবসায়ের মূলধন। এ কারণেই অবশেষে ২০২১ সালের ১লা জানুয়ারী থেকে গ্রামীণ করের আওতায় আসে। কিন্তু ইউনূস শাহী এবার এক ধাক্কায় আরো ৫ বছর নিজেদেরকে করমুক্ত করে নিলো।

২.
মানুষের অনেক রকম ফোবিয়া থাকে। ড. ইউনূসের একটি ফোবিয়া হলো কর ফোবিয়া। সে অনেকবারই বলেছে, সে কোনো সম্পদের মালিক হতে চায় না। এ কথা শুনে অনেকেই গদগদ হয়ে ভেবেছে, আহা! লোকটা কতোই না মনোরম! কতোই না দরিদ্রবান্ধব। দরিদ্রদের ব্যথা বুঝার জন্য সে নিজেও দরিদ্র থাকতে চায়। তাই কোনো সম্পদের মালিকানা চায় না। এই আহা পার্টি তার বাকচাতুর্যে ধোঁকা খেয়েছে। একবারও ভেবে দেখে নি, এই সম্পদহীন লোকটির জীবনযাপন আসলে কেমন। কিভাবে সে চাইলেই মুহূর্তের মধ্যে এদেশ-ওদেশ করতে পারে। বিপরীতে একজন সম্পদহীন দরিদ্র মানুষের জীবন কেমন।

তবে ড. ইউনূসের আর্থিক লেনদেনের মৌলিক প্যাটার্ন খেয়াল করলেই বুঝা যায় সমস্যাটি কোথায়। তার একটি নিঞ্জা টেকনিক হলো, সে উপার্জনকৃত টাকা পয়সা নিজেরই গড়া দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দিয়ে দেয়। তাও আবার মৃত্যুভয়ে ভীত হয়ে! তারপর সেখান থেকে নিজে ও পরিবারের লোকজন ইচ্ছেমতো খরচ করে। সরকার ট্যাক্স চাইতে এলে দাতব্য সংস্থা দেখিয়ে বলে, আমি গরীব, সম্পদহীন। সবই দান করে দিয়েছি। যেহেতু সম্পদ নাই, সেহেতু ট্যাক্সও নাই। ৪ঠা আগস্ট আদালতের রায়েই একটি মামলায় ইউনূসকে ৬৬৬ কোটি টাকা কর দেয়ার কথা বলা হয়। ৬৬৬ কোটি টাকা কর দিতে হলে মূল আয় কতো ক্যালকুলেটর নিয়ে হিসাব করেন। এরপর হিসাব করেন এরকম আরো কতোটি ক্ষেত্র এখনো মামলার বাইরে রয়ে গেছে। তাহলেই ইউনূসের আর্থিক শক্তি হিসেবে কিছুটা ধারণা পাবেন। এরকম সুপার রিচ ইউনূস দেশের জন্য কিছু কর দিতে গেলেই তার জ্বর আসে। আয়কর তার জন্য কতো বড়ো ফোবিয়া, তার উদাহরণ ক্ষমতা হাতে পাওয়ার ১ দিনের মাথায়ই নিজের কর মামলা প্রত্যাহার!

৩.
করমুক্তির ঘোষণায় ড. ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাঙ্ক আলোচনায় এলেও একই সুবিধা চুপিচুপি ভোগ করবে আহমাদুল্লাহর আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন। বেশিদিন আগের কথা না, ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এ সংস্থাটি নিজেদেরকে “ইসলামী দাতব্য সংস্থা” ঘোষণা দিয়ে মাত্র এই কয় বছরে ফুলে ফেঁপে উঠেছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলাদেশে সংস্থাটির নাম বহুল প্রচারিত না হলেও তারা আর্থিকভাবে প্রচণ্ড শক্তিশালী। মূলত ৫ই আগস্টের পর বন্যার সময় এরা আলোচনায় আসে। সংস্থাটির সাইনবোর্ডে “অলাভজনক ধর্মীয় দাতব্য সংস্থা, যারা শিক্ষা, দাওয়াত ও মানবকল্যাণসহ বিভিন্ন সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে” থাকলেও এটি ব্যবহৃত হয় মূলত সন্ত্রাসী খাতে অর্থ সংগ্রহ ও লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে। কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ এড়িয়ে দেশের মধ্যে ও বিদেশে অর্থ লেনদেনের জন্য এটি কাজ করে।

স্বভাবতই ড. ইউনূস যেমন নিজেকে করমুক্ত করছেন, তার নিয়োগদাতা অর্থাৎ জ*ঙ্গীগোষ্ঠীর স্বার্থও দেখছেন।

৪.
সাংবিধানিকভাবে অবৈধ ড. ইউনূস ক্ষমতায় বসেছেন “সংস্কার” করতে। দেশের মানুষকে ধোঁকা দেয়ার প্রজেক্ট হিসেবে তিনি এই মুলা দেখিয়েছেন। যে কোনো সিস্টেমেই সমস্যা থাকে। বাংলাদেশের মতো দুর্নীতি পরায়ণ দরিদ্র দেশে সমস্যার অন্ত নেই। সুতরাং আমজনতা পরিবর্তন চাইবে, এটিই স্বাভাবিক। ইউনূস এই সুযোগ নিয়ে তাদের সামনে সংস্কারের মুলা ঝুলিয়েছেন। লোকজন যাতে ভাবে যে, ড. ইউনূসের মতো জগদ্বিখ্যাত লোক, যে আমেরিকার রাজাবাদশাহদের সাথেও এক টেবিলে ভাত খায়, তার হাতে যাদুর কোনো কাঠি আছে, যার দ্বারা দেশকে সংস্কার করে আমেরিকা বানিয়ে দিবেন।

স্পষ্টতই এরকম কোনো যাদুর কাঠি ইউনূসের হাতে নেই। ইউনূস সৃষ্টিকর্তা নয় যে, “কুন ফায়া কুন” বললেই সবকিছু সৃষ্টি হয়ে যাবে। একটি দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রোসেস। এর জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকতে হয়, এবং সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নও করতে হয়। এই পরিকল্পনার কয়েকটি ধাপ আছে। যেমন, প্রথমেই আপনাকে স্টাডি করতে হবে সমস্যাটি কী এবং কোথায়। এরপর ভাবতে হবে এই সমস্যা অন্যান্য দেশ কিভাবে সমাধান করেছে। আমরা সেভাবে পারবো কি না, আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থায় বাস্তবসম্মত সমাধান কী হওয়া উচিত। এরপরে আসে বাস্তবায়ন। ড. ইউনূস ও তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা সমস্যা কি, সে সম্পর্কেই কোনো কথা বলেন নি। তাদের কাছে একমাত্র সমস্যা ছিলো “আওয়ামী লীগ”। আওয়ামী লীগ সরকার তাদের রাজনৈতিক ও আর্থিক অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে ওঠায় সেটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এখানে দেশের সমস্যার কোনো সমীকরণ নেই, দেশের মানুষের সমস্যা নিয়েও তারা কখনোই সিরিয়াসলি চিন্তা করেন নাই। এজন্যই সংস্কার, সংস্কার বলে গলা ফাটিয়ে ফেললেও সংস্কারের কোনো প্রাথমিক রূপরেখাও এই আড়াই মাসে ইউনূস দিতে পারেন নাই।

৫.
ড. ইউনূস টিয়া পাখির মতো বারবার বলে যাচ্ছেন, “দেশের মানুষ” তাকে দেশসংস্কারের জন্য ক্ষমতায় বসিয়েছে। অবশ্যই তিনি দেশের মানুষর ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় বসেন নি। তিনি ক্ষমতা দখল করেছেন জামায়াতের অর্থায়নে আমেরিকার পরিকল্পনায় আর্মির সামরিক ক্যু-এর মাধ্যমে। সমন্বয়ক গোষ্ঠী মূলত জামায়াত-শিবিরের লোকজন, যারা আমজনতা হিসেবে সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিয়ে প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে সরকারবিরোধী শ্লোগান দিতে প্রমোট করেছে। শহরকেন্দ্রিক এই আন্দোলনে অবশ্যই দেশের সিংহভাগ মানুষের অংশগ্রহণ ছিলো না। জামায়াতের বাইরে যারা অংশ নিয়েছিলো, তারাও যে ধোঁকাবাজির শিকার হয়েছিলো, তা এখন জলের মতো পরিষ্কার। এমনকি বিএনপির নেতারাও ভিতরের খবর জানতো না।

এই আন্দোলনে কখনোই ইউনূসের “দেশসংস্কার”-এর প্রসঙ্গ ছিলো না। বাহ্যিকভাবে, ইউনূস নিজেও কখনো এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন না। তবে তিনি অবশ্যই আমেরিকা-জামায়াত-আর্মির এই ষড়যন্ত্রের অংশ ছিলেন, পরিকল্পনায়ও ছিলেন। সরকার ফেলতে সফল না হলে কী হবে, সে আশঙ্কায় ফ্রান্সেও যান। ৫ই আগস্টের পর পরিস্থিতি বুঝতে সময় নেন আরো ৩ দিন। পাল্টা ক্যু না হওয়ায় নিশ্চয়তা পেয়েই দেশে আসেন। ক্ষমতায় বসেন। এই পুরো প্রক্রিয়ায় ড. ইউনূসের সাথে কখন দেশের মানুষের ডায়লগ হলো আর তাকে “সংস্কার”-এর জন্য ক্ষমতায় বসালো? কখনোই না।

দেশসংস্কার হলো ড. ইউনূসের মুলা। আমেরিকার সহায়তায় তিনি নিজে নিজেই ক্ষমতায় বসেছেন। মুলাটি ঝুলিয়েছেন, যাতে দেশের লোকজন কিছুদিন শান্ত থাকে। এর মধ্যেই তিনি শুধু নিজের ও দেশবিরোধী অপশক্তির আর্থিক ও রাজনৈতিক সুবিধা নিয়েই কাজ করছেন। সংস্কার গীত গেয়ে তিনি নিজেদের পকেট ভারী করছেন। দেশের মানুষের জন্য অর্থনীতি ও আইনের শাসন ধংস করা ছাড়া কিছু করছেন না। মানুষ তার গায়েবী সংস্কার ফর্মূলায় বেশিদিন বিশ্বাস করবে না, এটি তিনিও জানেন। তবে মানুষ জাগতে জাগতে নিজের পকেট ভারী করে দৃশ্যপট থেকে ভাগতে তিনি আদৌ সমর্থ হবেন কি না, সেটি কি তিনি জানেন?

#ATeam 20241030

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *