আন্দোলনকারীরা একটু ভাবুন (প্রথম পর্ব)
আপনি ব্যক্তিগতভাবে অবশ্যই আপনার পছন্দের জগতে বাস করতে পারেন। আপনি চিকেন খাবেন নাকি মাটন, চা নিবেন না কফি, সেটা আপনার ব্যক্তিগত পছন্দ। এমনকি ব্যক্তিগত পরিসরে চিন্তার ক্ষেত্রেও ঠিক-বেঠিকের হিসাব করার তেমন কোন দায় আপনার নেই। এসব ক্ষেত্রে আপনি একচোখা না দুইচোখা তাতে কিছুই আসে যায় না। যেমন ধরুন জুলাই আন্দোলন। আন্দোলন চলাকালীন আন্দোলনকারীরা যেমন নিহত হয়েছেন, তেমনি পুলিশও নিহত হয়েছেন। সমরযান থেকে ফেলে দেওয়া আন্দোলনকারীর লাশ যেমন আমরা দেখেছি, তেমনি ফুটওভার ব্রীজ কিংবা গাছে ঝুলন্ত পুলিশের মরদেহও দেখেছি। নিহত মুগ্ধের “পানি লাগবে পানি” কথাটি যেমন শুনেছি, সিরাজগঞ্জে গর্ভবতী নারী পুলিশ সদস্যের “আমাকে যেতে দেন পেটে বাচ্চা আছে” এমন আকুতিও শুনেছি। কিন্তু জুলাই আন্দোলনে নিহত পুলিশের বিষয়ে আপনার তেমন কোন আগ্রহ নেই, কারণ আপনি তাদের প্রতিপক্ষ মনে করেন। ব্যক্তিগতভাবে আপনার সাথে একমত না হলেও আমি মনে করি নিজস্ব পরিসরে এই মত আপনার থাকতেই পারে।
কিন্তু, যখন আপনি সরকারে যাবেন, উপদেষ্টা বা মন্ত্রী এই জাতীয় কোনো পদ পদবী নিবেন তখন কিন্তু আপনার আর “আমি মনে করি” বলার সুযোগ নেই। কারণ শপথ পড়ার সময় আপনি বলেছেন, আপনি সংবিধানে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিবেন। এখন আপনাকে কিছু মনে করতে হলেও ‘সংবিধান’ মেনে মনে করতে হবে। এখন আর আপনি আন্দোলনকারী নন, আপনি সরকার। পুলিশের দায়িত্বও আপনার আবার নাগরিক হিসেবে আন্দোলনে অংশ নেওয়া বা না নেওয়াদের দায়িত্বও আপনার। কিন্তু এর মধ্যে যদি আপনি একটি বিশেষ পক্ষ বেছে নেন, তাহলে বুঝতে হবে ওই পক্ষকে আপনি অবৈধভাবে বাঁচানোর কোনো পায়তাঁরা করছেন।
জুলাই আন্দোলনের প্রসঙ্গে আসি। সে সময় পুলিশ হত্যার একাধিক প্রতিবেদন গণমাধ্যমে এসেছে। প্রতিবারই আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা এর সাথে জড়িত নয়। এমনকি দেশব্যাপী যে ভাংচুর তাণ্ডব চালানো হয়েছে, তার সাথেও আন্দোলনকারীরা যুক্ত নয় বলে জানানো হয়েছে। শুধু আন্দোলনকারী কেন তৎকালীন সরকারও বলেছিল, এসব হত্যা-সন্ত্রাসের সঙ্গে শিক্ষার্থীরা জড়িত নয়। তো আন্দোলন যদি ছাত্রছাত্রীদের হয়ে থাকে, আর যাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন তারাই যদি সার্টিফিকেট দিয়ে বলে ছাত্রছাত্রীরা সন্ত্রাস করেনি, তাহলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে হঠাৎ দায়মুক্তি দিতে হলো কেন?
ড. ইউনূস তো বলছেন, এই সরকার মূলত ছাত্র জনতার সরকার। আর দায়মুক্তির বিষয়ে কথাও বলেছে সরকারে থাকা সমন্বয়কদের প্রতিনিধিদের একজন। তাহলে কি আন্দোলনটি শিক্ষার্থীদের ছিল না? নাকি সরকারে থাকা দুজন আসলে রাজনৈতিক পরিচয়ের মুখোশধারী শিক্ষার্থী? নাকি আন্দোলনকারীরাই হত্যা করে তখন অস্বীকার করেছে আর এখন দায়মুক্তি নিয়েছে?
আসলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারি করা দায়মুক্তির বিবৃতিটি আমাদের অনেকগুলো অন্ধকার দূর করে দেয়। প্রথম যে অন্ধকারটি দূর করে তা হলো, সরকারে থাকা আওয়ামী লীগ সেদিন আমাদের মিথ্যে কথা বলেছিল। তারা বলেছিল, শিক্ষার্থীরা হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল না, কিন্তু শিক্ষার্থীদের সরকার দায়মুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিল- আন্দোলনের নামে পুলিশ হত্যায় তারাই জড়িত ছিল।
আর দ্বিতীয় যে অন্ধকারটি দূর হয় তা হলো, দায়মুক্তির বিবৃতি জারির মাধ্যমে সরকার প্রমাণ করে দিল, পুলিশ হত্যার সুপ্রিম রেসপনসিবিলিটি বা সর্বোচ্চ দায় আদতে জুলাই আন্দোলনকারীদের। তাদের হাতে ক্ষমতা আছে সুযোগও আছে তাই তারা এখন তাদের দায়মুক্তি দিয়ে দিচ্ছে।
দায়মুক্তি কথাটির মানেই হলো, যে দায় ছিল তা থেকে মুক্তি দেওয়া হলো অর্থাৎ, তার জন্য কোন শাস্তি প্রযোজ্য হবে না। যেমন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। খুনীরা কিন্তু আত্মস্বীকৃত ছিল। অর্থাৎ, খুনের দায় তারা স্বীকার করেই দায়মুক্তি নিয়েছিল। আবার ২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত যৌথবাহিনীর পরিচালিত অপারেশন ক্লিন হার্টে নিরাপত্তা হেফাজতে যে ৪০ জনের মৃত্যু হয়েছিল, তারও দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। গণমাধ্যম থেকে সাধারণ মানুষ সবাই জানত যারা নিহত হয়েছে সবাই যৌথবাহিনীর অপারেশনেই নিহত হয়েছে, যৌথবাহিনীও জানত। এ কারণেই দায়মুক্তি নিয়েছে। একই ঘটনা ১৯৭৪ সালের রক্ষীবাহিনীকে দেওয়া দায়মুক্তির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সকলেই জানত রক্ষীবাহিনী অপরাধ করেছে, বাহিনীও সেটা জানত; সুতরাং দায়মুক্তি নিয়েছে।
জুলাই আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা এমনকি তাদের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ সরকারও বলেছিল, পুলিশ হত্যাকান্ডে শিক্ষার্থীরা জড়িত নয়। কিন্তু, ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তকালীন সরকার দুই পক্ষের দাবিতেই জল ঢেলে দিল। এখন এটা প্রমাণ হয়ে গেল, সারাদেশে নির্বিচারে নৃশংসভাবে যে পুলিশ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে, জুলাইয়ের আন্দোলনকারীরাই সেটা ঘটিয়েছে। শিক্ষার্থীদের দায় অস্বীকারের আর কোন সুযোগ নেই কারণ আপনাদের সরকারই দায়মুক্তি দিয়ে আপনাদের ওপর দায় চাপিয়ে গেছে। আপনি যে দায় অস্বীকার করেছেন, আপনার সরকার আপনাকে সেই দায় থেকে মুক্তি দিচ্ছে। কী তাজ্জব!
তবে এটাও তাদের ম্যাটিকুলাস আর ওয়েল প্ল্যানড ডিজাইনেরই একটি অংশ। কিভাবে সেটা পরের পর্বে।
#ATeam 20241038