আন্দোলনকারীরা একটু ভাবুন (দ্বিতীয় পর্ব)
আগের পর্বে বলেছিলাম, আপনি দায়ী না হলেও জুলাই মাসের নৃশংস পুলিশ হত্যাকাণ্ডের দায় আপনারই সরকার আপনার ঘাড়ে চাপিয়েছে। আপনার দায় ছিল বলেই আপনাকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। কী ভাবছেন? আমি বোকার মতো কথা বলছি? সারাদেশের এত এত আন্দোলনকারীদের যদি পুলিশ হত্যায় দায়ী করা হয়, তাহলে উপদেষ্টা পরিষদে থাকা দুজনসহ অন্যান্য সমন্বয়করা তো হবে হুকুমের আসামী, উপদেষ্টা পরিষদের অন্যান্যরা তো হবে মাস্টারমাউন্ড, ড. ইউনূস তো হবে হত্যাকান্ডের সুপ্রিম অথরিটি। তারা কেন নিজের পায়ে কুড়াল মারবে?
জ্বি, আপনার মতো এই বুদ্ধি আমার মাথাতেও খেলেছিল। সব বোকাদের মাথাতেই এ ধরনের বুদ্ধি একই ফ্রিকোয়েন্সিতে খেলে। কিন্তু, আমি আপনার চেয়ে একটু কম বোকা বলেই অতীতে জারিকৃত দায়মুক্তিগুলোর রকমসকম একটু বোঝার চেষ্টা করেছি। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৬টি দায়মুক্তির ঘটনা ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন কর্মকাণ্ড, ঘটনাবলী ও যুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্টদের দায়মুক্তি দিয়ে প্রথম অধ্যাদেশ জারি হয় ১৯৭৩ সালে, ১৬ নং আদেশ। দ্বিতীয়টি ছিল ১৯৭৪ সালের ১১ নং আদেশ, মানে আগের পর্বে বলা রক্ষীবাহিনীর দায়মুক্তি। তৃতীয়টি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের দায়মুক্তি ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর। চতুর্থটি এরশাদ সরকারের ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ৯ নভেম্বর পর্যন্ত জারিকৃত সকল আদেশের বৈধতা দেওয়ার জন্য সংসদে পাস হয় ১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর। পঞ্চমটি চারদলীয় জোট সরকারের সময় ২০০৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি বিল’ নামে জারি হয়। ষষ্ঠ দায়মুক্তিটি ছিল ২০১০ সালে আওয়ামী লীগের আমলে জারিকৃত ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানী দ্রুত সরবরাহ (বিশেষ বিধান)’ যা ২০২০ সাল পর্যন্ত বহাল রাখা হয়েছিল। (সূত্র: রক্ষীবাহিনীর অজানা অধ্যায়: কর্নেল সারোয়ার হোসেন মোল্লা, রাজনীতির কথা প্রসঙ্গে: হায়দার আকবর খান রনো ও সংবিধানের রাজনৈতিক বিতর্ক: আমীন আল রশীদ)
আলোচনার সুবিধার্থে উপরোক্ত ৬টি দায়মুক্তির ঘটনার মধ্যে আমরা প্রসঙ্গ বিবেচনায় কয়েকটির আলোচনা বাদ দিচ্ছি। প্রথম দায়মুক্তি মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘটনা, অর্থাৎ যুদ্ধ-পরবর্তী বাস্তবতা। দ্বিতীয় ও পঞ্চম দায়মুক্তি বাহিনী সংক্রান্ত। চতুর্থ আর ষষ্ঠ দায়মুক্তি সরকারবিষয়ক। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুলিশ হত্যাকাণ্ডের বিচার এড়াতে যে দায়মুক্তি দিল, তার সঙ্গে মেলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের খুনীদের দায়মুক্তি দেওয়ার প্রসঙ্গ। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা হত্যার পর রেডিওতে গিয়ে সদর্পে খুনের দায় স্বীকার করে এবং খন্দকার মোশতাককে দিয়ে দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারি করায়। সেই অধ্যাদেশ পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইন হিসেবে গৃহীত হয় জিয়াউর রহমানের সংসদে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই মোশতাকের মন্ত্রীসভায় যোগ দেয়। এই ইউনূস সাহেবের মতোই মোশতাকও দেশ চালিয়েছিল। খুনীদের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করেছিল।
দায়মুক্তি দেওয়ার ২১ বছর পরে ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে তা বাতিল করে এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার করে। এবার বিচারটি লক্ষ্য করেন, মোশতাকের বিচার হয়েছে? না। জিয়াউর রহমানের বিচার হয়েছে? না। মোশতাকের মন্ত্রীসভায় থাকা কারও বিচার হয়েছে? না। এমনকি সেনাপ্রধান হিসেবে থাকা সফিউল্লাহকেও কোনো আইনি জবাবদিহিতার মধ্যে পড়তে হয় নাই।
এবার ঠান্ডা মাথায় ভাবুন। আমি বিশ্বাস করি, আপনি আওয়ামী লীগের সেই সব মাথামোটা নেতাদের মতো নন, যারা ভেবেছিল আজীবন ক্ষমতায় থাকবে। সুতরাং, দৃশ্যপট বদলাবে, একদিন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে জাস্ট একটা রিট করে এই অধ্যাদেশ বাতিল করে দিবে। তারপর শুরু হবে বিচার প্রক্রিয়া। আপনি হয়তো ভাবছেন, আপনি ফারুক-ডালিমের মতো আত্মস্বীকৃত খুনী না কিন্তু এই ডিজিটাল যুগে আপনার ফুটেজ পাওয়া অসম্ভব নয়। আপনার কি ধারণা, পুলিশ ছেড়ে দিবে? তখন যে মামলার নহর বইবে, সেখানে আপনিও পড়ে যেতে পারেন। কারণ, দায়মুক্তির আদেশ বাতিল করা মানেই দায়ীদের বিচারের পথ খোলা।
তখন আপনি যতই গান গেয়ে বলেন, একদিন আওয়ামী লীগের নেতারাই বলেছিল শিক্ষার্থীরা পুলিশ মারে নাই, কোন লাভ হবে না। এই সমন্বয়করা তখন নিজেদের আখের গুছিয়ে ফেলবে। তাদেরও হয়তো ধরে এনে বিচার করা হবে কিংবা তারা হয়তো নাগালের বাইরেই থাকবে। কিন্তু, পুলিশ হত্যাকান্ডের বিচার কেউ আটকাতে পারবে না। আপনার ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট দেখবেন পুলিশ সংগ্রহ করে রেখেছে। অতএব, টা টা বাই বাই খতম…।
ভাবছেন এই বিচার করতে হলে আওয়ামী লীগকে লাগবে? না, যে কোনো রাজনৈতিক দলের কাছেই আপনাদের মতো জোম্বি বলদের চেয়ে পুলিশের লয়্যালিটি বেশি প্রয়োজন। সুতরাং, যে কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় বসে এই বিচার শুরু করতে পারে। বিএনপি তো অবশ্যই পারে, কারণ তারা তো জানে সরকার চালাতে পুলিশ কতো প্রয়োজন।
সুতরাং বিশ্বাস করেন, এই দায়মুক্তি বাতিল হওয়া ওয়ান টু’র মামলা। এটা এরাও জানে। তবুও তারা পুলিশ হত্যাকাণ্ড থেকে আপনাদের দায়মুক্তি দিয়েছে মূলত নিজেদের সাফসুতরো করার জন্য। একদিন এই দায়মুক্তির বিবৃতি বাতিল করে যখন বিচার আরম্ভ হবে, ড. আসিফ নজরুল দেখবেন তখনও টক শোতে গিয়ে বলবে, “এই অসভ্য ছাত্ররা এত চাপ দিয়ে দায়মুক্তিটা করিয়ে নিয়েছে যে কী বলবো।” উপদেষ্টা, সমন্বয়ক আর ইউনূস পর্যন্ত তখন উল্টো সুরে গাইবে।
বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বই, সাক্ষাৎকার তো এখন আপনাদের প্রিয়পাঠ্য। পড়ে দেখবেন সবাই বলেছে জিয়া সব জানত। পুলিশ হত্যাকান্ডের বিচার যখন শুরু হবে তখন আপনিও হয়তো বলবেন, মাহফুজ আলম সব জানত। তাতে কি! মাহফুজ আলম ততদিনে মাহফুজ আনাম হয়ে যাবে।
#ATeam 20241039