গণহত্যার দায়মুক্তি - বাংলার মাটিতে পুলিশ হত্যার বিচার হবেই

নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীতে পুলিশ কনস্টেবল হত্যা মামলায় কয়েকজনকে আটকের পরপরই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংবাদ বিবৃতি দিয়ে বলেছে, গণঅভ্যুত্থানকে সফল করতে যেসব ছাত্র-জনতা সক্রিয়ভাবে আন্দোলনের মাঠে থেকে এর পক্ষে কাজ করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে পনেরই জুলাই থেকে আটই অগাস্ট পর্যন্ত সংগঠিত গণঅভ্যুত্থান সংশ্লিষ্ট ঘটনার জন্য কোনো মামলা, গ্রেফতার বা হয়রানি করা হবে না।

সামান্য আইনের ছাত্র হিসাবে জানি, ফৌজদারি অপরাধে কাউকেই দায়মুক্তি দেয়ার সুযোগ নেই। এই অপরাধ কখনো তামাদি হয় না।

যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “যে কোনো বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের পর এতে যারা অংশ নেয় তাদের হয়রানি থেকে মুক্ত রাখতে এমন পদক্ষেপ নেয়া হয়।” [১]

এদেশ কি তাহলে, মবের (Mob) মুল্লুক? ৫ আগস্ট দুপুর ১২ টার পর থেকে হাজার হাজার আওয়ামী লীগ নেতা কর্মী হত্যা, পুলিশ হত্যা, লক্ষ লক্ষ বাড়িঘর, অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও থানা ভাংচুর, লুটপাট ও জ্বালিয়ে দেওয়া কোন কিছুরই বিচার হবে না? এর নাম বৈষম্যমুক্ত দেশ গড়ার সংস্কার? এর নাম আইনের শাসন?

ফৌজদারি অপরাধে দায়মুক্তির উদাহরণ কোথায় পেয়েছেন? দায়িত্বপালনরত অবস্থায় দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হত্যা করা হবে আর সেটার বিচার হবে না! এদেশের মানুষ ৭.৬২ মিলিমিটার অস্ত্র বা কার্তুজে নিহত হলো যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবহার করে না – এই বিষয়টার তার তদন্ত হবে না? এই মানুষগুলো ‘প্ল্যান ম্যাটিকুলাস’ অনুযায়ী স্রেফ বলি হয়ে এই Mob (ভিড়) কে রাষ্ট্রক্ষমতায় নিয়ে আসলো সাম্রাজ্যবাদের দালালী করার জন্য?

ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ

গোল্ডফিশের মোমোরি না হলে নিশ্চয় মনে আছে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারবর্গ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনি ব্যবস্থা থেকে অনাক্রম্যতা বা শাস্তি এড়াবার ব্যবস্থা প্রদানের জন্য বাংলাদেশে “ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ” আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ এ ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন। এটি ১৯৭৫ সালের অধ্যাদেশ নং ৫০ নামে অভিহিত ছিল। পরে ১৯৭৯ সালে সংসদ কর্তৃক এটি অনুমোদন করা হয়। যার ফলে এটি একটি আনুষ্ঠানিক আইন হিসেবে অনুমোদন পায়। ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই বাংলাদেশ সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর পর সংশোধিত আইনে এ আইনটি বাংলাদেশ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। [২]

দীর্ঘ ২১ বছর পরে আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে সপ্তম জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারকার্য শুরু করেন। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সংবিধানের ৫ম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে বাংলাদেশ হাইকোর্ট। [৩]

এবার একটু ক্রনোলজি মিলিয়ে দেখেন: খুনিদের দায়মুক্তি দিয়ে অধ্যাদেশ হয়েছে, সংসদ অনুমোদন করেছে, আইন হয়েছে এবং সর্বশেষ সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর পর সংশোধিত আইনে বাংলাদেশ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়েছে?

এই বাংলার মাটিতে বিচার হবেই

এই বাংলার মাটিতে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার হয়েছে। শাস্তি হয়েছে। যেসব খুনি পালাতক রয়েছে তাদের বিদেশের মাটিতে মুখলুকিয়ে পালিয়ে থাকতে হয়। ‘ইনডেমনিটি’ নিয়ে এক সময় তারা গর্ব করে ‘খুনি’ পরিচয় নিয়ে দম্ভ করতো।

আজ যারা আন্দোলনের নামে পুলিশ হত্যা করেছে, সাধারণ মানুষকে হত্যা করে লাশের গণনা বাড়িয়েছে মধ্যবিত্তকে রাজপথে নামিয়েছে, থানা লুট করেছে, সরকারি সম্পদ বিনষ্ট করেছে, আমজনতার জানমাল নষ্ট করে ‘দায়মুক্তি’র প্রেস রিলিজ গর্বে বুক ফুলিয়ে বেড়াচ্ছে তারা জেনে রাখুন এই বাংলার মাটিতে তাদের বিচার হবেই।

কেন টার্গেট পুলিশ?

একাত্তরের ২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে যে সামরিক অভিযানে পরিকল্পিত গণহত্যা চালানো হয় দেশজুড়ে, তার অন্যতমস্থান ছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইনস। পাকিস্তানি হানাদারের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধও সেখানেই। সাড়ে তিন ঘণ্টার যুদ্ধে রাজারবাগের বাঙালি পুলিশ সদস্যরা সামান্য থ্রি-নট-থ্রি নিয়ে প্রাণপণে লড়ে যান ভারী অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। সেইরাতে শহীদ হন কমপক্ষে দেড়শ বাঙালি পুলিশ সদস্য। [৪]

১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত পুলিশের মোট সদস্য সংখ্যা ছিল তৎকালীন আইজিপি (প্রয়াত) তসলিম উদ্দিন আহাম্মদসহ ৩৩ হাজার ৯৯৫ জন। সেই সময়ে সরকারের তথ্য অনুসারে, সারা দেশে প্রায় ১৪ হাজার বাঙালি সদস্য পাকিস্তান সরকারের আনুগত্য অস্বীকার করেন এবং কর্মস্থল ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের একজন ডিআইজি, চার জন পুলিশ সুপার, এক জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, এক জন ডিএসপি, এক জন এসডিপিও, ১২ জন পুলিশ পরিদর্শক, ৮১ জন উপ-পুলিশ পরিদর্শকসহ ৭৫১ জন পুলিশ শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধের দলিল অনুযায়ী ১২৬২ জন পুলিশ সদস্য দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন। [৫] [৬]

যে পুলিশ রাজারবাগে প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধে বুক পেতে দিয়েছিল হানাদার বাহিনীর বুলেটের সামনে সেই পুলিশকে তার স্বাধীন দেশে গণহত্যা করা হয়েছে! থানায় ঢুকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল ফ্লাইওভারের দুইপাশে। কাঠ কয়লার মত পুড়িয়ে মারা হয়েছে। পুলিশ সদস্যকে হত্যার পর পুকুরে ফেলে রাখা হয়। জীবন বাঁচাতে মসজিদে আশ্রয় নিয়েছিল সেখানেও হত্যা করা হয়েছে। অন্তঃসত্ত্বা নারী পুলিশ কেও রেহাই দেয়া হয়নি।

সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরে থানায় আক্রমণ করে, আগুন লাগিয়ে ১৩ জন পুলিশ সদস্যকে হত্যার ঘটনা। হত্যার পর একজন পুলিশ সদস্যের গলায় ফাঁস দিয়ে গাছে ঝুলিয়ে রাখার ছবি আসে গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে। ওই ঘটনার পর প্রায় দুই মাস পার হয়ে গেলেও এখনো দায়ীদের গ্রেফতার করা হয়নি! [১]

হাইপোথিসিস

এবার একটা হাইপোথিসিস (একটি ঘটনার জন্য প্রস্তাবিত ব্যাখ্যা) বলি –
৩টা বিষয়ের কো-রিলেশন হয় কী না দেখেন।

এক. মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ এবং প্রায় অর্ধেক ফোর্স জয়েন করেছিল মুক্তিযুদ্ধে। এর জন্য কারা পুলিশের শত্রুজ্ঞান করে?

দুই. কারা ক্ষমতায় আসার পরপর পুলিশকে বাইপাস করতে যৌথবাহিনীকে দিয়ে অপরাধ দমনের জন্য যৌথবাহিনী দিয়ে অপারেশন ক্লিন হার্ট [৭] করে? কারা যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় [৮] র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) গঠন করে?

তিন. গত ১৫ বছরে কেন বিভিন্ন আন্দোলনের সময় বারবার পুলিশকে টার্গেট করা হয়েছিল?

পুলিশ যেহেতু এই সমাজের অংশ, এই সমাজের দোষ-গুণ সব তার থাকবে। বাংলাদেশের পুলিশ যেমনই হোক না কেন দিন শেষে দেশ এবং দেশের মানুষের জন্য জীবন দিতে দ্বিধা করে না। দেশের প্রতি এদের আনুগত্য প্রশ্নাতীত। তাই তো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তির টার্গেট তারা।

বাংলাদেশ পুলিশ তাদের স্বকীয়তা বজায় রাখলে মাস্টারমাইন্ড এবং মাস্টারমাইন্ডের মাস্টাররা এ দেশের মানুষ সাম্রাজ্যবাদের গিনিপিগ বানাতে পারবে না। তাই পুলিশকে নিষ্ক্রিয় করে খেলবে তাদের খেলা।

ফ্রাঙ্কেনস্টাইন
‘প্ল্যান ম্যাটিকুলাস’ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়ি থেকে সব মিলিয়ে পুলিশের ৫ হাজার ৮২৯টি অস্ত্র ও ৬ লাখ ৬ হাজার ৭৪২ রাউন্ড গুলি লুট হয়েছে। [৯]

এবার নিজেকে প্রশ্ন করুন তো আপনার ভ্যাট-ট্র্যাক্সের টাকায় কেনা সেই অস্ত্র কী কাজে ব্যবহারের জন্য লুট করানোর হয়েছে? টিকটক করার জন্য? না, আপনার আমার বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য?

বিশ্বজুড়ে ল এন্ড অর্ডার ধরে রাখতে সব দেশের সরকার অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পুলিশ হত্যার বিচার করে। (এই সরকার পুলিশ হত্যার বিচার চায় না কারণ তারা আইনের শাসন চায় না) ইউরোপের দেশগুলোতে যেখানে মৃত্যুদণ্ড নেই সে সব দেশে পুলিশ হত্যাকারীদের জামিন দেয়া হয় না। যেখানে বিশ্বজুড়ে নানা ধরণের আইনি সুরক্ষাকবজ দিয়ে পুলিশের সর্বচ্চ পেশাদারিত্ব আদায় করা হয় সেখানে মবের মুল্লকে মব জাস্টিস কে জাস্টিফাই করতে পুলিশ হত্যাকারীদেরকে দায়মুক্তি দেয়া হচ্ছে। মেধাবী-বৈষম্যবিরোধীরা এই দায়মুক্তি দিয়ে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের মুখে আরেকবার চুনকালি মাখিয়ে দিল।

সারা পৃথিবীতে একটি অলিখিত রীতি মেনে চলে সব দেশের পুলিশ, সেটা হলো পুলিশ কখনো পুলিশ হত্যাকারীকে ছাড়ে না।
এখন দেখেন! আপনারা যা ভালো মনে করেন। দায়মুক্তি দিয়ে পুলিশ হত্যাকারী ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের আতঙ্কে থাকবেন? না পুলিশের হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনার পক্ষে দাঁড়াবেন?

#ATeam 20241047

তথ্যসূত্র:
১. মামলা-গ্রেফতার থেকে দায়মুক্তির প্রশ্ন আসছে কেন, কারা পাবে? | https://www.bbc.com/bengali/articles/c4g9ynqdzglo

২. ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সুবিধাভোগী | https://www.dailyjanakantha.com/details/article/292673/ইনডেমনিটি-অধ্যাদেশ-এবং-বঙ্গবন্ধু-হত্যাকান্ডের-সুবিধাভোগী/

৩. ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ | https://bn.wikipedia.org/wiki/ইনডেমনিটি_অধ্যাদেশ

৪. রাজারবাগ পুলিশ লাইনস: মুক্তিযুদ্ধের প্রথম লড়াই | https://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article1868476.bdnews

৫. মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের বীরত্বের ধারক | https://www.ittefaq.com.bd/274466/মুক্তিযুদ্ধে-পুলিশের-বীরত্বের-ধারক

৬. আমরা কি জানি মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের অবদান? | https://www.dhakawave.com/details/1904/dhakawave.com/details/1904/আমরা-কি-জানি-মুক্তিযুদ্ধে-পুলিশের-অবদান

৭. Operation Clean Heart | https://en.wikipedia.org/wiki/Operation_Clean_Heart

৮. র‌্যাব যুক্তরাজ্য ও আমেরিকার সৃষ্টি: পররাষ্ট্রমন্ত্রী | https://bangla.bdnews24.com/samagrabangladesh/article2003585.bdnews

৯. বাংলাদেশ পুলিশের প্রায় ৬ হাজার অস্ত্র লুট | https://www.ittefaq.com.bd/698868/বাংলাদেশ-পুলিশের-প্রায়-৬-হাজার-অস্ত্র-লুট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *