ভূমিকা:
বিএনপির একাংশ এবং জামায়াতের একটি ন্যারেটিভ আছে, শেখ মুজিব মুক্তিযুদ্ধ করেন নি। পাকিস্তানের হাতে “সারেন্ডার” করে তিনি বরং দেশকে বিপদে ফেলেছিলেন। এরপর জিয়া, ওসমানীরা যুদ্ধ করে দেশ “স্বাধীন” করেছে। কিন্তু ১৯৭২ সালে উড়ে এসে শেখ মুজিব আবার জুড়ে বসে “মুজিববাদের” সংবিধান করে মুক্তিযুদ্ধকে অসম্মান করেছেন।
তাদের এই ন্যারেটিভের একটি সারসংক্ষেপ পাওয়া যায় [১]-এ উল্লিখিত মাহমুদুর রহমানের বক্তব্যে। মাহমুদুর রহমান বলেছেন, “স্বাধীনতাযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা শুরু হয়। সবাইকে বাদ দিয়ে এক ব্যক্তির বন্দনা শুরু হয়। যে ব্যক্তির স্বাধীনতা সংগ্রামের যে স্টেজ সেখানে ভূমিকা ছিল; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে কোনো ভূমিকা ছিল না, সেই ব্যক্তির নাম শেখ মুজিবুর রহমান। কারণ, তিনি মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে স্যারেন্ডার করেছিলেন।”
তিনি আরো বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের যে চরিত্রগুলো তাদের আস্তে আস্তে মেরে ফেলা হলো। যেমন মুক্তিযুদ্ধের চরিত্র যদি আমি বলি, জিয়াউর রহমান, তিনিই প্রথমে যুদ্ধটা শুরু করেছিলেন। যেটাকে মুক্তিযুদ্ধ বলি। মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র জেনারেল ওসমানী। তিনি প্রধান সেনাপতি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র মওলানা ভাসানী।”
এখান থেকে আমরা মাত্র একটি সোর্স ব্যবহার করে নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজবো:
১) মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিবের ভূমিকা কি ছিলো?
২) ওসমানী প্রধান সেনাপতি। জিয়া সেক্টর কমাণ্ডার। শেখ মুজিব যুদ্ধের সময় কী ছিলেন?
৩) মুজিবনগর সরকার চালাতেন তাজউদ্দিন, সৈয়দ নজরুল ইসলামরা। শেখ মুজিব কী সেখানে অনুপস্থিত ছিলেন?
সোর্স:
উপরে যে সোর্সের কথা বললাম, সেটি হলো ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার কর্তৃক প্রণীত “বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র”। সেখানে আছে,
“যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করার পরিবর্তে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে পারষ্পরিক আলোচনাকালে ন্যায়নীতি বহির্ভূত এবং বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করেন;
এবং
যেহেতু উল্লিখিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান;”
“বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি এবং এর দ্বারা পূর্বাহ্নে শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি;”
“এতদ্বারা আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন;
এবং
রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন;”
“আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, আমাদের এই স্বাধীনতার ঘোষণা ১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চ থেকে কার্যকর বলে গণ্য হবে।”
মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিবের ভূমিকা:
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশ নামক প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান। যে মুজিবনগর সরকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করছিলো, তার প্রধান যদি মুক্তিযুদ্ধ না করে থাকেন, তাহলে মুক্তিযুদ্ধ কি করেছিলো মাহমুদুর রহমানের আব্বু? যুদ্ধের সময় রাষ্ট্রপ্রধানকে সবসময় রাইফেল হাতে ময়দানে থাকতে হয় না, এই অর্বাচীনদেরকে কে বুঝাবে? পাকিস্তানে কারাগারে অন্তরীণ শেখ মুজিবের নামে দেশের মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, শুধু বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধারাই নয়, বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনীও শেখ মুজিবের নেতৃত্বেই যুদ্ধ করেছে। শেখ মুজিবের চেয়ে বড়ো মুক্তিযোদ্ধা তাহলে কে?
মুক্তিযুদ্ধে ওসমানী, জিয়া, মুজিবের অবস্থান:
অন্যতম সেনাপতি জিয়া অবশ্যই একজন সম্মানিত সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। আতাউল গনি ওসমানী ছিলেন প্রধান সেনাপতি। মুক্তিযুদ্ধে তাদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা আছে। উপরের সোর্সে দেখেন, শেখ মুজিবের অবস্থান। তিনি বাংলাদেশের সব সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক! মুক্তিযুদ্ধে কার অবস্থান কোথায়, সেটা কি বুঝা গেলো?
তাজউদ্দিন, সৈয়দ নজরুল, মুজিবের অবস্থান:
এই ১০ই এপ্রিল, ১৯৭১-এর ঘোষণায়ই বঙ্গবন্ধুকে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান ঘোষণা করা হয়। সৈয়দ নজরুল হন উপ-রাষ্ট্রপতি। পুরো মন্ত্রীসভা গঠিত হলে তাজউদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করা হয়। সৈয়দ মনসুর, মুশতাক, আবদুস সামাদ আজাদসহ অন্যরা মন্ত্রী হন। পাকিস্তানের জেলে বন্দী মুজিবকে বাদ দিয়েই তো তারা সরকার গঠন করতে পারতেন। কেন করেন নি? কারণ, মুজিব হলেন একটা ব্রান্ড। একটা অনন্য ব্রান্ড। মুজিবে নামে বাঙালি জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে, মুজিবের নামে ভারত বিনাদ্বিধায় বাঙালি শরণার্থীদেরকে আশ্রয় দেয়, মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংসহ সাপোর্ট দেয়, মুজিবের এক কথায় ইন্দিয়া গান্ধী যুদ্ধ শেষে ভারতীয় সৈন্য ফিরিয়ে নেন। পাকিস্তানের জেলে বন্দী থাকলেই যদি মুজিব অপ্রাসঙ্গিক হতে যেতেন, তাহলে তাকে মুজিবনগর সরকারের প্রধান করা হতো না। তখন তো ৭২ সালও আসে নাই। এপ্রিল, ৭১। যুদ্ধ মাত্র শুরু। দেশ শত্রুমুক্ত হবে, সে নিশ্চয়তাও নেই। তখন কেন একা মুজিবকে এই অনন্য উচ্চতায় বসানো হলো?
বটমলাইন:
মানুষের অজ্ঞানতার সুযোগ নেয় মাহমুদুর রহমানের মতো জ্ঞানপাপীরা। তারা তাজউদ্দিন, ওসমানী, জিয়াদেরকে আপাতভাবে বড়ো করে দেখাতে গিয়ে মুজিবকে মাইনাস করে দেয়। কারণ, তারাও জানে, মুজিবকে মাইনাস করা মানে মুক্তিযুদ্ধকেই মাইনাস করা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ধারাবাহিক সংগ্রামই নয়, বাংলাদেশের ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধেও মুজিব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ এবং তার উচ্চতায় আর কেউই নেই। মুজিব একজনই। জাতির জনক একজনই হয়।
[১]”মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিবের কোনো ভূমিকা ছিল না : মাহমুদুর রহমান | Liberation War |Sheikh Mujibur Rahman”, ২০শে অক্টোবর, ২০২৪
#ATeam 20241049