টাক মুখে দাড়ি

রাজ্যের বেবাক কবিরাজকে রাজ দরবারে তলব করা হলো। এলান জারী হলো, যে করে হোক রাজার মুখে দাড়ি গজায়ে দিতে হবে, না হয় সবাইরে কঠিন শাস্তির আওতায় আনা হবে। সময় মাত্র সাতদিন। রাজা সবার উদ্দেশ্যে বললেন সুচিকিৎসার স্বার্থে যা কিছু জানার আপনারা নির্ভয়ে আমাকে প্রশ্ন করতে পারেন, পরামর্শ দিতে পারেন।

দরবার জুড়ে কবিরাজদের ফিসফিস। টাক মাথায় চুল গজানোর বহু চিকিৎসা তারা করেছে, কিন্তু টাক মুখে দাড়ি! কিভাবে সম্ভব! চট্টগ্রাম হতে আগত বিখ্যাত মোসলেম কবিরাজ কুর্নিশ করে প্রথম প্রশ্ন করলেন,

  • মহারাজ, আমি আপনার চাঁটগাইয়া কবিরাজ। অভয় দিলে একটা প্রশ্ন করি?
  • যত ইচ্ছা, প্রাণ খুলে প্রশ্ন করুন।
  • আপনার বয়েস কত? না, মানে, দাড়ি গজানোর বয়েস হয়েছে কি না বুঝতে চাচ্ছি আরকি মহারাজ!

প্রশ্ন শুনেই রাজা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। চড়া গলায় পেয়াদা হিজুকে ডেকে বললেন, এই কবিরাজের বাচ্চারে এক্ষুণি একটা হত্যা মামলার আসামীর লিস্টে ঢুকিয়ে দাও, জেলে নিক্ষেপ করো। হিজু মোসলেম কবিরাজকে টেনে নিতে নিতে বললেন,

  • মহারাজ, খিলগাঁও থানার সেই মামলায় ৭০১ নম্বর আসামীর সীট ফাঁকা আছে, বসায়ে দেই?
  • এত পেছনে! সামনের দিকের সীট ফাঁকা নেই?
  • ৯৪ নম্বর ফাঁকা ছিলো মহারাজ, গতকাল জেড আই খান পান্না সেই সীটে বসে গেছে।
  • সেও কি আমার দাড়ি নিয়া কিছু বলছিলো?
  • বলার সুযোগ পায় নাই মহারাজ, তার আগেই বসায়ে দিছি!

চাঁটগাইয়া কবিরাজের এহেন বেহাল দশায় দরবারে আতংক ছড়িয়ে পড়লো। এদিকে রাগে-ক্রোধে রাজার চোয়াল এখনও শক্ত হয়ে আছে। কোনও কবিরাজ প্রশ্ন করতে চাইছে না। জটলার মধ্য থেকে খাটো মতন একজন হাত তুলে প্রশ্ন করার সাহস দেখালেন। রাজা সহাস্যে তাকে অভয় দিয়ে সামনে এসে প্রশ্ন করতে আহবান জানালেন।

  • মহারাজ, আমি সেলামত কবিরাজ। বাড়ি কুমিল্লায়, আসিফ নরজুল স্যারের এলাকায়। আমি একটা প্রশ্ন করি?
  • প্রাণ খুলে…

কথা শেষ না করতেই রাজার ফোন বেজে উঠলো। হিলারির ফোন। নিশ্চয়ই একটা সমাধান পাওয়া গেছে! রাজা ফোন রিসিভ করলেন,

  • হ্যা, হিলু বলো, ইফেক্টিভ কোন মেথড জানতে পারছো?
  • লিসেন মাই ডিয়ার, কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি..
  • কি বললো?
  • বললো তোমার পুরুষ হরমোন টেস্টেস্টোরন টেস্ট করে দেখতে। এই হরমোন নাকি কম থাকলে দাড়ি গোঁফ উঠে না।
  • দূর্বাল, এই বয়সে সেই হরমোন থাকে নাকি! তুমি অন্য মেথড দেখো। সামথিং কবিরাজী টাইপ, লাইক কলিকাতা হারবাল, এজ ইউ নৌ।
  • ওকে, আন্ডারস্টুড।
  • দ্রুত দেখো হিলু! হাতে সময় কম, জনগণ আমারে সাতদিনের আল্টিমেটাম দিয়ে দিছে!
  • কিসের আল্টিমেটাম?!
  • গন্ডোগোল লাগাইছো তুমি, আর এখন বলো কিসের আল্টিমেটাম! কে বলছে তোমারে বিশ্বের প্রভাবশালী মুসলিমের তালিকায় আমার নাম হান্দাই দিতে? এখন জনগণ সেন্টি খাইয়া প্রশ্ন তুলছে, “প্রভাবশালী মুসলিম হইছো, তোমার দাড়ি কই মিয়া?”
  • ওএমজি!
  • শুধু তাই না, মিছিলে স্লোগান দিচ্ছে–
    এক দফা এক দাবী, সাতদিনে দাড়ি গজাবি।
    সাতদিনে দাড়ি গজাবি, নইলে তুই গদি ছাড়বি।।
  • ওএমজি ওএমজি!! সময় দেখি একেবারেই কম, আমি রাখি সোনা।

রাজা ফোন রেখে জানালায় নির্বাক তাকিয়ে আছেন।বাইরে ঝড়ের তান্ডব, বাগানের গাছগুলো সব দুমড়ে মুচড়ে শুয়ে পড়ে পড়ে অবস্থা। অবচেতন মনে রাজা টাক মুখে দাড়ি হাতরাচ্ছেন আর ভাবছেন, আগামী কয়দিন জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরানোর একটা কৌশল নিলে কেমন হয়। প্রেসসচিবকে ইশারায় ডেকে কানেকানে বললেন, প্রেস রিলিজ দিয়ে দাও.. আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করে পূর্বনোটিশ ছাড়া ইন্ডিয়া তাদের ঝড়ো বাতাস বাংলাদেশের দিকে ছেড়ে দিছে।

এদিকে মহারাজের একান্ত ঘনিষ্ঠ হিলু-টাইপ ফোনালাপ শুনে কুমিল্লার সেলামত কবিরাজের মাথায় নরজুল স্যারের ফাঁস হওয়া ফোনালাপের কথা মনে পড়ে গেল। তিনি চিন্তা করলেন, এই মুহুর্তে নরজুল স্যারের রেফারেন্স হিতে বিপরীত হয়ে বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাই কৌশল পাল্টিয়ে বললেন,

  • মহারাজ, আপনি টেনশন নিয়েন না। দাড়ি গজানোর চিকিৎসায় বংশ পরমপরায় কুমিল্লা জুড়ে আমার বাপদাদার সুনাম ছিলো এবং আছে।
  • কেমন সুনাম? দু একটা একজাম্পল দাও।
  • যেমন, পাকিস্তান আমলে আমার দাদারে জিন্নাহ সাহেবের দাড়ি গজানোর জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে হায়ার করে নিয়েছিলো, যদিও দাদা আর ফিরে আসে নাই!
  • বলো কি! আর?
  • আমার বাবা কুমিল্লায় খন্দকার মোস্তাক সাহেবের দাড়ি গজানোর জন্য গঠিত সাত সদস্য বিশিষ্ট কবিরাজ বোর্ডের সভাপতি নিযুক্ত হয়েছিলেন..

কবিরাজের কথা শেষ হতে না হতেই হিজু মোবাইলে গুগল ইমেজ সার্চ দিলেন। জিন্নাহ আর মোস্তাক সাবের দাড়ি গজানোর প্রমাণ না পেয়ে হিজু হাত উঁচিয়ে চিল্লায়া উঠলেন, মুরুব্বি মুরুব্বি উহু উহু…! মহারাজের হুকুমের অপেক্ষা না করে হিজু কবিরাজকে টেনে হিঁচড়ে নিতে নিতে বললেন,

  • তোর দাদা জিন্নাহ সাবের দাড়ি গজায়া দিছে, না? বাবায় মোস্তাক সাবের দাড়ি গজায়া দিছে? শালা বেহুদা কবিরাজ। বাপদাদার শাস্তিও তোরে পাইতে হবে!
  • বাবা, পিলিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও, পিলিজ.. ক্ষমা করে দাও..

দরবার হল একেবারেই চুপ। পিন পতন শব্দ নেই। সকল কবিরাজ ভয়ে হাত কচলাচ্ছে। একমাত্র নোয়াখালীর বিখ্যাত কবিরাজ আব্দুল মজিদ বুক ফুলিয়ে নির্ভার দাড়িয়ে আছে। বাদবাকী কবিরাজদের এখন শেষ ভরসা এই মজিদ। মজিদ দু’ কদম সামনে এগিয়ে বললেন,

  • মহারাজ, দাড়ি নিয়ে আমার একটা সুমিষ্ট অভিজ্ঞতা আছে, অভয় দিলে বলি–
  • তোমার দাড়ি কই মিয়া?
  • গল্পটা ঐ জায়গাতেই, বলবো?
  • বলো
  • একদা আমারও দাড়ি ছিল। পথেঘাটে দেখা হলে লোকজন বলতো, দাড়ি রাখছো, টুপি কই মিয়া?
  • বলো কি!
  • তারপর টুপি পরা শুরু করছি। হেরপর লোকজন বলতো, দাড়ি রাখছো টুপি পরছো ভালো কথা কিন্তু শুক্রবারে জুম্মায় দেখি না ক্যান? কোন মসজিদে নামাজ পরো?
  • ওএমজি ওএমজি! তারপর?
  • তারপর আবার কি মহারাজ, সাবেক অবস্থায় ফিরে এসেছি। অবশ্য আপনার ক্ষেত্রে এসব প্রশ্ন আসবে না, আপনিতো মহারাজ প্রভাবশালী মুসলিম!

রাজা সিংহাসন ছেড়ে কিছুক্ষণ এলোপাতাড়ি পায়চারি করলেন। তারপর স্থির হয়ে হিজুকে ডেকে বললেন,

  • শুনো মাস্টারমাইন্ড, সামনে ঝামেলা আছে। এত তাড়াতাড়ি দাড়ি গজানো যাবে না, পরে নামাজের জন্য গদি থাকবে না। তুমি বরং আপাতত: কবিরাজ মজিদকে প্রধান করে পাঁচ বছর সময় বেঁধে দিয়ে এক সদস্য বিশিষ্ট একটা কমিশন করে দাও, দাড়ি গজানো কমিশন।

#ATeam 20241050

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *