১.
সোহেলকে নিয়ে তার সামনেই হাসিঠাট্টা, রসিকতা করলেও সে গায়ে মাখতো না। আমরাও ভ্যানগার্ড কিনতাম। ৫ টাকা, নাকি ১০ টাকা এতোদিনে দাম ভুলে গেছি। তবে দাম নিয়ে দামাদামি হতো না। যা দিতাম, তাতেই সে খুশি। তাকে আমরা কিছুটা সমীহও করতাম। কারণ, রাজনীতিতে সে-ই ছিলো আমাদের বন্ধুমহলের অবিসংবাদিত পণ্ডিত। এমন সব বাঘা বাঘা দার্শনিক, চৈনিক-রাশিয়ান রাজনীতিকের নামের রেফারেন্স ধরে ধরে সে ঘন্টার পর ঘন্টা বয়ান দিতে পারতো যে, আমরা শুধু অবাক দৃষ্টিতে তার কথা শুনতাম। তবে ভিতরে তেমন একটা ঢুকতো না। ছাত্র ইউনিয়ন আর তার সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের পার্থক্য কি, এটাই আমাদের নিরেট মস্তিষ্কের ফায়ারওয়াল ভেদ করতে পারতো না।
সে পণ্ডিত লোক, গুরু মানুষ মেনে নিতাম। কিন্তু তার সমাজতন্ত্রকে আমাদের মতো আনপড় ঝামা লোকজন মানতে পারে নাই। এই এতো বছর পরেও আমার কাছে সমাজতন্ত্র মানে কিছুসংখ্যক লোকের একনায়কতন্ত্র। আমার ভাগ্যের সূতা যেমন একনায়ক ড. ইউনূসের মতো একজনের হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিত বোধ করতে পারি না, তেমনি ইউনূস ও তার উপদেষ্টাদলকে যদি সমাজতন্ত্র ভাবি, তাহলে তাদের হাতেও আমি নিরাপদ নই। আমার ভাগ্যের সূতোয় আমার নিজেরও কিছু বক্তব্য থাকতে হবে। গণতন্ত্রই সেটি আমাকে দেয়। আর রাশিয়া, চীনের উদাহরণতো খুব আকর্ষণীয় কিছু না। আমি জানি, আমি ভুল। সমাজতন্ত্রের নিশ্চয়ই কিছু মহৎ উদ্দেশ্য আছে, যেগুলো শুধু বন্ধু সোহেল এবং তার মতো ইন্টেলেকচুয়াল পোলাপানই ভালো জানে।
আরেকটি প্রশ্ন ছিলো, সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিতে এতো শতো ধারা কেন। বাংলাদেশেই এদের ভোট নেই ২%; কিন্তু দল আছে ৫০টা। ফলাফল, নির্বাচনে সবারই জামানত বাজেয়াপ্ত। এরকম বিভক্তি আছে শুধু ইসলামী দলগুলোর ভিতরে। একই আল্লাহর ইসলাম; কিন্তু তার মধ্যে দল যদি হয় ৫০টা, তাও আবার প্রত্যেকে দাবি করে, তারাই সঠিক, বাকি সব ভণ্ড, তাহলে আমজনতা হিসেবে কোনদিকে যাই! পরবর্তীতে ইসলামী দলগুলোর সুলুক সন্ধান করে বুঝেছি, আল্লাহ ইসলাম নিয়ে রাজনীতিই করতে বলেননি। রাজনীতিতে অনেক পঙ্কিলতা থাকে, ইসলাম নিষ্কলুষ। যারা ইসলামকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে, তারাই আখের গোছানোর জন্য এরকম ভাগাভাগির সৃষ্টি করে। তবে ইসলামী রাজনীতি বুঝলেও সমাজতন্ত্রের রুটি ভাগাভাগি বিষয়ে আমি এখনো অজ্ঞ। সোহেল অনেকভাবে বুঝানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু, আমাকে বিজ্ঞ করতে পারে নাই, অজ্ঞই রয়ে গেছি।
রাজনীতিতে এই অজ্ঞ হওয়ার জন্য এখনো দুঃখবোধ নেই, তখনো ছিলো না। বরং, সোহেলের জন্য কিছুটা করুণা ছিলো। ছাত্রলীগ, ছাত্রদলের নেতারা যেখানে ক্যান্টিনে ফাও খাচ্ছে, আবার আমরা ছোটভাইরা আবদার করলে আমাদেরকেও মিছিলের পর চা খাওয়ার টাকা দিচ্ছে, সেখানে একজন ভ্যানগার্ড বেঁচে রাজনীতি করছে, বিষয়টা অমানবিক লেভেলের সৎ মনে হতো। ভ্যানগার্ড কোনোদিন পড়ে না দেখলেও কিনেছি প্রতিবার। সৎ লোকদের সাহায্য করা নৈতিক দায়িত্ব।
তবে বন্ধুদের কেউ কেউ বলতো, তাদের রাজনীতির পুরোটাই যে সততা, এমন তথ্য সঠিক না। অনেকেই বাম রাজনীতি করে প্রেম করার লোভে। আমাদের কনজারভেটিভ সোসাইটিতে যে সব মেয়ে চালু, তাদের একটা অংশই বাম রাজনীতির সক্রিয় অংশ। তারা উদার। রাত-বিরেতের আড্ডা নিয়ে তাদের কোনো অভিযোগ নেই, বিড়ি-সিগারেটেও তারা ছেলেদের সাথে সমানে সমান। সেই আমলে অ্যালকোহল সহজলভ্য ছিলো না। তবে এই ছেলেমেয়েদের সম্পর্কে একটা অভিযোগ ছিলো যে, এরা ঠিকমতো গোসল-টোসল করে না। আমি অবশ্য সেটি সাক্ষ্য দিতে পারবো না। সোহেল নিয়মিত গোসল করতো।
২.
সমাজতন্ত্রের রাজনীতি করা সব পোলাপানই পণ্ডিত হয়। তবে সবাই ভালো বক্তা হয় না। সবাই ভালো মিশুকও হয় না। সোহেল ছিলো কমপ্লিট প্যাকেজ। তার দলের ভিতরে সে তরতরিয়ে উন্নতি করতে থাকতে। প্রত্যেক ছাত্রসংসদ নির্বাচনেই সে অংশ নিতো। ভোট পেতো না তেমন। আমরা তার বন্ধুবান্ধবরাই প্যানেল দেখে লীগ বা দলকে ভোট দিতাম, তার প্রতি ভোটের সময় করুণা করতাম না। কিন্তু, সে কখনো হতোদ্যম হয়ে পড়েনি। জানতো, আমরা তাকে ভোট দেই নাই। তবে একদিন না একদিন আমরা ঠিকই বুঝবো তার রাজনীতির আদর্শ। হতোদ্যম হলে বিল্পব দাঁড় করানো যায় না।
আমরা যখন ফোর্থ ইয়ারে, তখন সে হলো তার দলের ভিপি ক্যান্ডিডেট। ভার্সিটিতে সোহেলের বক্তৃতা শুনতে ছাত্রছাত্রীরা জড়ো হয়ে যেতো। তারা তার কথা কতোটুকু বুঝতো, না বুঝতো বলতে পারবো না। তবে আমরা বন্ধুরা তাকে পাত্তা না দিলেও ক্যাম্পাসে তার যে পাত্তা আছে, সেরকমই মনে হতো। এর মধ্যে সোহেলের চোখ পড়লো গিয়ে সেকেন্ড ইয়ারের লিপির ওপর। লিপি ছিলো ক্যাম্পাসের ফেম ফাতাল। আমার মতো আম-ছাত্র যেখানে লিপির সামনে গিয়ে কথা বলা দূরে থাক, চোখের দিকে তাকানোরও সাহস সঞ্চয় করতে পারতাম না, সোহেল সেখানে তাকে সরাসরি প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে দিলো।
প্রেমের ফর্মূলা অনুসারে সে সফল হওয়ার কথা। মাত্রাতিরিক্ত সুন্দরীদের ভক্ত আশেকান থাকে অনেক; কিন্তু তাদেরকে প্রেমের প্রস্তাব দেয় না নিশ্চিত প্রত্যাখ্যানের ভয়ে। ফলে, তারা সুন্দরী হওয়ার পরেও দেখা যায় প্রেমিক নাই। সেক্ষেত্রে কেউ যদি সাহস করে কাছে গিয়ে প্রেমের প্রস্তাব দেয়, তাহলে সেটি লুফে নেয়ারই কথা। ভাববেন না, এসব তত্ত্বকথা তখন জানতাম। তখন জানলে তো ভয়ের মাথা খেয়ে আমিই লিপিকে প্রস্তাব দিয়ে বসতাম। যাহোক, এই তত্ত্ব সোহেলের ক্ষেত্রে খাটে নাই। লিপি তাকে নাকচ করে দেয়। আমরা বেশ অবাক হয়েছিলাম। সোহেল দেখতে শুনতে সালমান খান না হলেও খারাপ না। আগেই বলেছি, ছাত্রফ্রন্ট করার পরেও সে নিয়মিত গোসল করতো। পরিপাটি থাকতো। কথাবার্তায় ক্যারিশমা ছিলো। সে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর আমরা লিপির দেমাগ নিয়ে অনেক চর্বিত চর্বণ করেছি। লিপির এক বান্ধবী অবশ্য মাস কয়েক পরে আমাকে বলেছিলো, সোহেল ছাত্রফ্রন্ট করার জন্যই নাকি লিপি তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। সে বলেছে, এই ছেলের কোনো ভবিষ্যত নাই।
৩.
আমরা যখন পাস করে বের হই, তখনো সোহেলের কিছু কোর্সে ফেল ছিলো। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে এরপর যোগাযোগ কমে যায়। টিএসসির নিয়মিত আড্ডায় সে কম আসতো। তবে ফোনে কথা হতো। একসময় সে পাশ করে বের হয়। চাকরি-বাকরিও করে। কিন্তু তার মধ্যে বেশ কিছু আমূল পরিবর্তন ঘটে যায়। সে হঠাৎ করে খুব বেশি ধার্মিক হয়। যে কথা ভার্সিটিতে তাবলীগ জামাতের ভাইয়েরা বলতো, সে কথা এখন সোহেল বলে। বেশ কয়েকবার সে চিল্লা দিয়েও এসেছে।
আমি ধার্মিক মানুষ। ধর্মে আমার অ্যালার্জি নেই, থাকার প্রশ্নও আসে না। কিন্তু বন্ধুদের আড্ডা বা কথোপকথনে যদি ধর্মের আলাপই মূখ্য হয়ে ওঠে, তখন আর সেটি বন্ধুদের আড্ডা থাকে না। সোহেলের সাথে কথা বলে আর আগের মতো মজা পাই না। ফোনে খোঁজ-খবর নেয়া নেহাৎই কর্তব্য পালনের মতো হয়ে ওঠে। কেমন আছো, ভালো আছির পর কথা বাড়িয়ে নেয়ার মতো টপিক খুঁজতে গলদঘর্ম হই। পরে আবার ফোন দিবো দোস্ত বলে লাইন কেটে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি।
সোহেলের বেশভূষায়ও পরিবর্তন হয়। পাঞ্জাবিও পরে, আবার প্যান্টে ইন করে শার্টও পরে। কিন্তু চাপদাড়িতে পরিপূর্ণ মুখমণ্ডলের সোহেলকে দেখে কেউ বুঝতে পারবে না, মাত্র কয়েক বছর আগেও এই যুবক সমাজতান্ত্রিক শোষণমুক্ত উদার সমাজের বক্তৃতা দিয়ে মাঠ কাঁপাতো।
তার সাথে যোগাযোগ অনেক কমে যায়।
৪.
ফেসবুকের কল্যাণে বেশ কয়েক বছর পর অবশ্য আবার নিয়মিত যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ফেসবুকে সে বেশ সরব। দেখে আসলেই ভালো লাগে। নাহ, সোহেলকে আমরা একেবারেই হারিয়ে ফেলি নি। সে এখনো রাজনীতি সচেতন। ক্ষমতাসীনদের সমালোচনায় সে এখনো ক্ষুরধার। অবশ্য তার সব সমালোচনাই আওয়ামী লীগ কেন্দ্রিক। ফেসবুক আমলে যেহেতু আওয়ামী লীগই ক্ষমতায়, সেহেতু তাদের সমালোচনাই স্বাভাবিক হবে। আশ্চর্য হই নি। তবে মাঝে মাঝে বাড়াবাড়ি মনে হতো। অনেক সময়ই মনে হতো মাত্রা ছাড়া। আওয়ামী লীগের কোনো মন্ত্রী দুর্নীতি করলে ৭১-এর স্বাধীনতাকে কেন ভর্ৎসনা করতে হবে, মাথায় ঢুকতো না। শেখ মুজিব কি তাকে দুর্নীতি করতে বলে গেছেন? নাকি দেশটা স্বাধীন করে বিশাল অন্যায় করে ফেলেছেন? তবে সোহেলের সাথে ফেসবুকে এসব আলাপে যেতাম না। সে জ্ঞানী মানুষ, কোন কোন দার্শনিকের কীসব রেফারেন্স দিয়ে আমাকে আটকে দিবে, সেই বেইজ্জতির ভয়ে এসব স্ট্যাটাস ইগনোর করতাম।
ফেসবুক আমলে অবশ্য সোহেলের সাথে টেলিফোনে যোগাযোগটাও বাড়ে। সাংসারিক আলাপটাই বেশি হতো। রাজনৈতিক আলাপ এড়িয়ে যেতাম।
লালবিপ্লবের সময়টায় অনেকের মতো সোহেলেরও অলআউট রূপটা দেখি। যেকোনো মূল্যে হাসিনাকে হঠাতে হবে। হঠানোর পরে কী হবে, এই প্রশ্নের উত্তরে তারও জবাব পরেরটা পরে দেখা যাবে। আমি অবশ্য গত কয়েক বছরে লীগের উপর মহলের নেতাদের কাজকর্মে তাদের ওপর বিলা ছিলাম। আমার কর্মক্ষেত্রেও তাদের কারণে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। কে কতো বড়ো আওয়ামী লীগার, সে কথা প্রমাণে লোকজন এতো ব্যস্ত থাকতো যে, অফিসের কাজটাই কেউ ঠিকমতো করতে চাইতো না। আমি চাইতাম, আওয়ামী লীগ সংশোধিত হোক। কিন্তু, শেখ হাসিনাকে হঠালে কীভাবে দেশের ভালো হবে, সেই সমীকরণের কোনো সমাধান খুঁজে পেতাম না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য শেখ হাসিনাকে অপরিহার্য মনে হতো। সোহেল অবশ্য রাজনীতির পণ্ডিত। তবে তার পাণ্ডিত্যের প্রতি শ্রদ্ধাটা এতো বছরে অনেকটাই কমে গেছে।
৫.
৫ই আগস্টের পর থেকে সোহেল যেন একদম ভিন্ন মানুষ। তাকে জীবনে এতো খুশি কখনোই দেখি নাই। তবে গত আড়াই মাসে ইউনূস সরকারের কাজকর্মে তাকে মাঝে মাঝে শকড এবং কনফিউজড মনে হয়েছে। “সে এটা কেন করলো” জাতীয় দুয়েকটা স্ট্যাটাস দিয়েছে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর পোঁড়ানো, শিক্ষকদেরকে গণ পদত্যাগ করানো এসব হাই প্রফাইল অপকর্মের প্রতিক্রিয়া হিসেবে। তবে আওয়ামী লীগের প্রতি তার ঘৃণার রেশ একটুও কমেনি। সে এখনও পারলে জেমস বন্ড সেজে শেখ হাসিনাকে দিল্লী থেকে হাইজ্যাক করে নিয়ে এসে ফাঁসি দিতে পারলে খুশি হয়।
৫ই আগস্টের পর থেকে সোহেলকে ফোন দেয়া বন্ধ করেছি।
তবে সে নিজে থেকেই ফোন দেয়। কণ্ঠে উল্লাস থাকে। মাঝে মাঝে হতাশাও। গতকাল ফোন দিয়ে বললো, “দোস্ত, লিপিকে ডিভোর্স দিয়ে দিলাম!”
আমি আকাশ থেকে পড়ি। তার ২টা বাচ্চা। এখনো ছোট। এ অবস্থায় ভাবীকে ডিভোর্স দিলে পুরো পরিবার যে পথে বসবে! হঠাৎ করে এমন কী হলো!
সোহেলই ভুল ভাঙিয়ে বলে, “আরে পাগোল, তোর ভাবীকে ডিভোর্স দিবো কোন দুঃখে? ডিভোর্স দিলাম লিপিকে।” আমি সম্বিত ফিরে পেলাম। ভাবীর নাম তো শবনম মমতাজ। লিপি, আহা! সেই লিপি।
“কিন্তু, তুই লিপিকে ডিভোর্স দিবি কীভাবে? লিপি তো তোরে সেই অধিকার দেয় নাই।” – পাল্টা প্রশ্ন করি।
সোহেলের উত্তর, “ডিভোর্স দিতে কী আর অধিকার লাগে দোস্ত! এখন আমাদের সবার হাতে এক একটা আলাদীনের চেরাগ। যা ইচ্চা তাই করতে পারি, অধিকার লাগে না। ড. ইউনূসকে বাংলাদেশের অধিকার কে দিয়েছে? সে যদি আজ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করতে পারে, আমি লিপিকে ডিভোর্স দিতে পারমু না ক্যান!”
#ATeam 20241064