সমন্বয়কের পুলিশ গণহত্যার স্বীকারোক্তি - আইন কি বলে? ‘দায়মুক্তি’ না শাস্তি?

সমন্বয়কের পুলিশ গণহত্যার স্বীকারোক্তি –
আইন কি বলে? ‘দায়মুক্তি’ না শাস্তি?

‘যদি মেট্রোরেলে আগুন না দেওয়া হতো, যদি পুলিশদের না মারা হতো তাহলে এই বিপ্লবটা এত সহজে অর্জিত হতো না। ফ্যাসিবাদের পতন নিশ্চিত করা যেত না’—সম্প্রতি বেসরকারি টেলিভিশন ডিবিসির ‘প্রযত্নে বাংলাদেশ’ টকশোতে অংশ নিয়ে এমন মন্তব্য করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম।

শনিবার (২৬ অক্টোবর, ২০২৪) ডিবিসির নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে অনুষ্ঠানটির ভিডিওটি প্রকাশ করা হয়। টকশো’র মূল প্রতিপাদ্য ছিল ‘জাতীয় ঐক্যে কতটা চ্যালেঞ্জ’। টকশোতে বক্তা হিসেবে হাসিবুল ইসলামের পাশাপাশি আরও ছিলেন বিএনপি নেত্রী নিলুফার চৌধুরী মনি। [১] [২]

উল্লেখ্য যে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত জুলাই-আগস্টে দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতায় ৪৪ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। গত শুক্রবার (২৫ অক্টোবর, ২০২৪) তাঁদের নামের তালিকা প্রকাশ করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। [৩] অসমর্থিত সূত্র অনুযায়ী এই নিহতের সংখ্যা তিনশতাধিক। রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতির বিষয়ে এখনো সরকারি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়নি।

স্বাভাবিকভাবেই এই মন্তব্য দেশের আইন-শৃঙ্খলার জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং অনৈতিক ও আইনগতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। বিচার বিভাগীয় প্রক্রিয়ায় এই ধরনের বক্তব্য কিভাবে প্রভাব ফেলতে পারে তা নিয়ে আইনি বিশ্লেষণ প্রয়োজন।

সাক্ষ্য হিসেবে মিডিয়ার মন্তব্য: আইনি দৃষ্টিকোণ

হাসিবুল ইসলামের টেলিভিশনে দেওয়া বক্তব্যটি যদি আদালতে স্বীকারোক্তি হিসেবে গণ্য করা হয়, তবে এটি বিভিন্ন আইন অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য হতে পারে, তবে তার বক্তব্যকে “সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ” করতে হলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান থাকতে হবে। সাধারণত, ফৌজদারি বিচার প্রক্রিয়ায় স্বীকারোক্তি স্বতঃপ্রণোদিত হতে হয়, এবং এতে কোনো প্রকার প্ররোচনা বা চাপ দেওয়া হয় না। এর পাশাপাশি, মিডিয়াতে দেওয়া মন্তব্য সরাসরি আদালতে প্রমাণ হিসেবে নেওয়ার জন্য যথাযথ ফৌজদারি সাক্ষ্য আইন অনুযায়ী বিশ্বাসযোগ্যতার মানদণ্ড পূরণ করতে হবে।

এখানে, মিডিয়াতে প্রচারিত মন্তব্যকে বাংলাদেশের সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ অনুযায়ী গ্রহণযোগ্যতার মানদণ্ডে মাপা হতে পারে, কারণ এই আইন অনুযায়ী কোনো ব্যক্তির বক্তব্যকে প্রমাণ হিসেবে গৃহীত করতে হলে তা নির্ভরযোগ্য ও যথাযথ প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হতে হবে।

‘দায়মুক্তি’ কার্যকর হবে?

হাসিবুলের মন্তব্যের প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক বিবৃতি রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, “১৫ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানের সাথে সংশ্লিষ্ট আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা, গ্রেফতার বা হয়রানি করা হবে না।” [৪] এ ধরনের বিবৃতি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কারণে দায়িত্বমুক্তি দিলেও ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে এই বিবৃতি কোনো ব্যক্তিকে আদালতে দায়মুক্তি দিতে পারে না।

বাংলাদেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় ফৌজদারি অপরাধ, বিশেষত হত্যাকাণ্ড, অগ্নিসংযোগ বা গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে সাক্ষ্য, প্রমাণ, এবং আইনের ধারা অনুযায়ী বিচারের নির্দেশনা রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি শুধু প্রশাসনিক নির্দেশনা হিসেবে গণ্য হবে এবং বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা বজায় রেখে আদালত অপরাধের দায় নির্ধারণ করতে পারে।

দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এবং অন্যান্য প্রযোজ্য আইনে উল্লেখ রয়েছে যে, হত্যাকাণ্ড, অগ্নিসংযোগ বা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি ধ্বংসের অপরাধ কখনোই তামাদি হয় না।

সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণের শর্ত ও প্রমাণ সংগ্রহের পদ্ধতি

হাসিবুল ইসলামের বক্তব্য যদি আদালতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হিসেবে গৃহীত হয়, তবে এর জন্য বেশ কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে। প্রথমত, মিডিয়ার ভিডিও বা অডিওকে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে এর সত্যতা নিশ্চিত করতে বিশেষজ্ঞদের দ্বারা যাচাই করা প্রয়োজন। আদালতে এই ধরনের প্রমাণ উপস্থাপনের ক্ষেত্রে ভিডিও ফুটেজের উৎস, সম্পাদনা বা হেরফের না হওয়া নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়াও, সাক্ষীর মাধ্যমে এমন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রমাণ পেশ করা হতে পারে যা বক্তব্যের সমর্থনে অবদান রাখে।

প্রযোজ্য আইন ও দণ্ডবিধির ধারা

যদি হাসিবুল ইসলামের মন্তব্য সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়,

হাসিবুল ইসলামের টেলিভিশনে দেওয়া বক্তব্যকে আদালতে স্বীকারোক্তি হিসেবে গণ্য করা হয় এবং আদালত এটিকে নির্ভরযোগ্য স্বীকারোক্তি হিসাবে আমলে নেন, তবে তিনি বিভিন্ন আইনের আওতায় দণ্ডিত হবে।

নিম্নে কিছু প্রাসঙ্গিক আইনের ধারা উল্লেখ করা হলো, যা হাসিবুল ইসলামের বিরুদ্ধে প্রয়োগ হতে পারে:
বাংলাদেশ দণ্ডবিধি, ১৮৬০:

ধারা ৩০২ (হত্যা): পুলিশের হত্যা বা হত্যার প্ররোচনায় প্রমাণ পাওয়া গেলে, ধারা ৩০২ অনুসারে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে।

দণ্ডবিধির ধারা ৩২৬ এবং ৩২৭ (আঘাত করা): পুলিশ বা অন্যান্য ব্যক্তিকে আঘাত বা মারাত্মক জখম করলে এই ধারা প্রযোজ্য হতে পারে। শাস্তি কারাদণ্ড বা জরিমানার হতে পারে।

ধারা ৪৩৬ (অগ্নিসংযোগ): মেট্রোরেলে আগুন দেওয়া হলে রাষ্ট্রীয় বা জন-সম্পত্তির ক্ষতিসাধনের দায়ে ধারা ৪৩৬ এর আওতায় সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তি আরোপিত হতে পারে।

সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯:

ধারা ৬ (সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততা): সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বা সংঘর্ষে উস্কানি দেওয়ার জন্য এই ধারা প্রযোজ্য হতে পারে। এই আইনের অধীনে দোষী সাব্যস্ত হলে দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে।

ধারা ৬(২) অনুযায়ী, সহিংস আন্দোলনের জন্য জনগণকে উস্কানি দেওয়া সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে দেখা হয়। এতে শাস্তি কারাদণ্ড হতে পারে।

জননিরাপত্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ২০০০:

এই আইনে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে বিপজ্জনক কর্মকাণ্ডে প্ররোচনা দেওয়ার জন্য কঠোর শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে।
এই আইনি ধারাগুলোর আওতায়, স্বীকারোক্তির প্রকৃতি এবং অন্যান্য সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আদালত হাসিবুল ইসলামের শাস্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারবে।

আইন এবং মানবাধিকারের মূলনীতি

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- “সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।” [৭] সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র (Universal Declaration of Human Rights)- ১৯৪৮ এর ৭ নং অনুচ্ছেদে কোনো ধরনের বৈষম্য ছাড়া আইনি প্রতিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে সমান অধিকারের ব্যাপারে উল্লেখ আছে। এই ধরনের নীতি রাষ্ট্রের আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই আইন এবং মানবাধিকারের মূলনীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

সমন্বয়কেরা আইনের ঊর্ধ্বে?

রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের সময় পুলিশ গণহত্যা শিকার হবে। জাতীয় গণমাধ্যমে গর্ব করে গণহত্যার দায় স্বীকার করা হবে। কিন্তু ‘অভ্যুত্থান’ বা ‘বিপ্লব’ এ সব শব্দ বলে মব-এর মুল্লুকে অপরাধীরা মুক্ত হয়ে ঘুরে বেড়াবে! সমন্বয়কেরা আইনের ঊর্ধ্বে! মব জাস্টিস আইনসিদ্ধ! এটাই রাষ্ট্র সংস্কার? বৈষম্যমুক্ত দেশ?

এখন দেখেন! আপনারা যা ভালো মনে করেন।

#ATeam 20241068

তথ্যসূত্র:
[১] ‘মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, কিংবা পুলিশদেরকে না মারা হলে বিপ্লবটা এত সহজে অর্জিত হতো না’: সমন্বয়ক হাসিবুল | https://www.tbsnews.net/bangla/বাংলাদেশ/news-details-271106
[২] ‘July Revolution could not have been realized without metro rail fires, killing of police officers’ | https://www.dhakatribune.com/bangladesh/politics/363300/coordinator-hasib-without-metro-fire-and-police
[৩] জুলাই-আগস্টে নিহত পুলিশ সদস্যদের তালিকা প্রকাশ | https://www.prothomalo.com/bangladesh/zqhqbxhiij
[৪] জুলাই গণঅভ্যুত্থান সংশ্লিষ্ট ঘটনার জন্য কোন মামলা, গ্রেফতার বা হয়রানি করা হবে না- স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় [প্রেস রিলিজ] | https://mhapsd.gov.bd/site/press_release/ec0dbe50-920c-4506-8a40-178aa41c19ee/
[৫] The Penal Code, 1860 ( ACT NO. XLV OF 1860 ) | http://bdlaws.minlaw.gov.bd/act-11.html
[৬] সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯ (২০০৯ সনের ১৬ নং আইন) | http://bdlaws.minlaw.gov.bd/act-details-1009.html
[৭] আইনের দৃষ্টিতে সমতা | http://bdlaws.minlaw.gov.bd/act-957/section-29993.html

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *