রিসেটবাবার ইকোনমিক শক থেরাপি

আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক শহিদ বোলসেন ৫ই আগস্ট আমেরিকান ব্লু-প্রিন্টের রেজিম চেঞ্জ ষড়যন্ত্র বাংলাদেশে সংঘঠিত হবার ঠিক পর পরই বলেছিলেন যে পশ্চিমারা বাংলাদেশকে প্রথমেই একটা ইকোনমিক শক থেরাপির ভেতর ফেলবে। সম্প্রতি আইএমএফের প্রকাশিত একটি রিপোর্টে এটি পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে যে, সাম্রাজ্যবাদীদের আরোপিত ইকোনমিক শক থেরাপি ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে এই সরকারের দ্বারা এটা এড়ানো সম্ভব না। এড়ানো সম্ভব না কারণ প্রেসক্রিপশনটা বাইরে থেকে আসলেও তা বাস্তবায়িত করছে এই সরকার খোদ নিজেই।

(তথ্যসূত্র- https://www.youtube.com/watch?v=JJsN5yB5hPM )

প্রথমে আইএমএফের দু’টি ভিন্ন সময়ে প্রকাশিত দুটি রিপোর্ট দেখা যাক।

মে,২০২৪ এ প্রকাশিত আইএমএফের রিপোর্টে দেখা যায়, “আগামী (২০২৪-২৫) অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৬.৬ শতাংশ হবে। একইসঙ্গে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ার পাশাপাশি আগামী অর্থবছর মূল্যস্ফীতিও কমে ৭.২ শতাংশে নেমে আসবে বলে জানিয়েছে এই দাতা সংস্থা”।

(তথ্যসূত্র- https://bangla.dhakatribune.com/economy/80475/ )

কিন্তু সম্প্রতি অক্টোবর,২০২৪ এ প্রকাশিত রিপোর্টে আইএমএফ এটিকে রিভাইস করে। তারা জানায়, “২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে ৪.৫ শতাংশে নামবে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়াতে পারে ১০.৭ শতাংশে”।

(তথ্যসূত্র- https://www.banglatribune.com/business/news/869296/ )
আইএমএফের এই দু’টি আন্তর্জাতিক রিপোর্ট থেকে সহজেই অনুধাবন করা যায় খুব দ্রুতই অর্থনীতির জন্য অন্যতম আতঙ্কের পরিস্থিতি ‘স্ট্যাগফ্লেশন” এর পাল্লায় পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

এখন এই স্ট্যাগফ্লেশন আসলে কী?

এটা বোঝার জন্য আমাদের প্রথমেই জানতে হবে মূল্যস্ফীতি কী? কোন নির্দিষ্ট সময়কালের তুলনায় বর্তমানে জনগণের জীবনযাত্রার নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তুর -যেমন, খাদ্য কাপড়, পোশাক, বাড়ি, সেবা ইত্যাদি- মূল্য বৃদ্ধির যে পার্থক্য তাই মূল্যস্ফীতি। সোজা ভাষায় মূল্যস্ফীতি সাধারণত চাহিদা আর যোগানের উপর ভিত্তি করে নিয়ন্ত্রিত হয়। একটা দেশের অর্থনীতির আকার বাড়লে, সেদেশের মানুষের হাতে অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ফলে তাদের পণ্য ও সেবার ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং অন্যদিকে ক্রয় ক্ষমতা বাড়ার জন্য পণ্য ও সেবার চাহিদাও বেড়ে যায়। চাহিদার সাথে যোগানের সামঞ্জস্যতা কমে গেলে পণ্য ও সেবার মূল্য বেড়ে যায়। তখন মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পায়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক তখন বাজারে অর্থের প্রবাহ কমাতে তফসিলি ব্যাংকগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হতে যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ দেওয়া হয় তার সুদহার বাড়িয়ে দেয় একে ‘নীতি সুদহার’ বলে। বাংলাদেশও এটি বাড়িয়ে চলেছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে। এর ফলে তফসিলি ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের জন্য ঋণের সুদহার বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়। অধিক সুদহারের জন্য গ্রাহকেরা ঋণ গ্রহণ করতে নিরুৎসাহিত হন। ফলে বাজার ব্যবস্থায় অর্থ প্রবাহের লাগাম টেনে ধরা যায়। অর্থ প্রবাহ কমলে চাহিদা কমে ফলে মূল্যস্ফীতি হ্রাস পায়। এর প্রভাবে আরেকটি ব্যাপার ঘটে, ঋণ প্রবাহ হ্রাসের ফলে বিনিয়োগ কমে যায়। কারণ বিনিয়োগকারীরা অধিক সুদে ঋণ নিতে উৎসাহ হারান। যার জন্য কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস পায়।

সোজা বাংলায়, অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বাড়লে মূল্যস্ফীতি বাড়ে, সেটাকে কমাতে গেলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান হ্রাস পায়। তাই সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই দু’টি ব্যাপারের ভেতর একটা সামঞ্জস্য বজায় রাখে, যাতে মূল্যস্ফীতি সহনীয় থাকে অন্যদিকে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানও বৃদ্ধি পায়। যাকে মোটামুটি আদর্শ অর্থনীতি ব্যবস্থা বলা যায়।

কিন্তু ঠিকঠাকমতো ব্যালেন্স না করা গেলে বাজার অর্থ সরবারহ কমে যাওয়ার জন্য বিনিয়োগ ঠিকই হ্রাস পাবে অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান কমবে কিন্তু অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাস্ফীতি কমার বদলে বৃদ্ধি পাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদ হার বাড়াতে থাকলেও মিলবে না কোনো সুফল। এ ধরণের পরিস্থিতিকেই বলা হয় স্ট্যাগফ্লেশন। যেকোন দেশের অর্থনীতির জন্যই এটা একটা নাইটমেয়ার।

কোভিডের মতো মহামারি, প্রকৃতি সৃষ্ট দুর্যোগ বা ইউক্রেন রাশিয়ার মতো ইম্পেক্টফুল যুদ্ধের তীব্রতার জন্য স্থানীয় পর্যায়ে বা বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিতে স্ট্যাগফ্লেশনের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ নিয়ে আইএমএফের উল্লেখিত প্রথম প্রতিবেদনে দেশটি বিভিন্ন বৈশ্বিক দুর্যোগ মোকাবেলার পর যে আদর্শ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দিকে পুনরায় এগিয়ে যাচ্ছিলো তার শক্তপোক্ত আভাস ছিলো। কিন্তু সেখানে এমন কি ঘটলো পাঁচ মাসের ভেতর যার জন্য বাংলাদেশ এখন স্ট্যাগফ্লেশনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। এখানেই চলে আসে শহিদ বোলসেনের বিবৃত ‘ইকোনমিক শক থেরাপি’।

কিছু ঘটনার দিকে দৃষ্টিপাত করলে, কীভাবে এই পশ্চিমা পাপেট সরকার এই ইকোনমিক শক থেরাপির প্রাথমিক পর্যায় বাস্তবায়িত করছে তা বোঝা যাবে।

১) দেড়শোরও বেশি দেশি বিদেশি কোম্পানি বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে শেষ আড়াই মাসে। যা আরো অনেক বাড়বে। (তথ্যসূত্র- https://www.bbc.com/bengali/articles/c6250z9l46lo )

২) শেয়ার বাজারের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ৫ই আগস্টের পর থেকে শেয়ার বাজার ২ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি পুঁজি হারিয়েছে। যা এখনো চলমান। এই টাকাটা আক্ষরিকভাবেই মার্কেট থেকে নাই হয়ে গিয়েছে। কারা এর সাথে জড়িত তাও কেউ জানে না। সম্ভবত বর্তমান সরকারের কাছের লোকজনই এটার সাথে জড়িত বলে এই ব্যাপার নিয়ে কোন কিছুই প্রকাশিত হচ্ছে না। বলা হচ্ছে চার বছরের ভেতর সবচেয়ে বড় ধ্বস নেমেছে পুঁজি বাজারে। কিন্তু যা বলা হচ্ছে না তা হলো চার বছর আগে ছিলো ২০২০ সাল অর্থাৎ কোভিড-১৯’র সময়। সংবাদমাধ্যমে লকডাউনের পুঁজি বাজারের সাথে মেলানো হচ্ছে স্বাভাবিক সময়ের বাজারকে।

৩) তৈরি পোশাক খাত আশঙ্কাজনক হারে বিদেশি বায়ার হারাচ্ছে। ইতোমধ্যে ১৫-২০ শতাংশের মতো ক্রয়াদেশ হারানোর শঙ্কা দেখা দিয়েছে। যা আরো বাড়তে পারে। (তথ্যসূত্র- https://www.prothomalo.com/business/industry/zdam9rssi0 )

৪) বহু ফ্যাক্টরিতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।

৫) জঙ্গিদের গণহারে মুক্তি দেওয়া এবং থানা ও জেল থেকে অসংখ্য অস্ত্র লুট ভবিষ্যৎ বিনিয়োগকারীদের জন্য স্থায়ী নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করেছে।

৬) আগে এক বা দুইটি পণ্যের দাম সাময়িক সময়ের জন্য উচ্চমূল্য দেখা দিলেও এখন একই সাথে প্রায় সকল নিত্য পণ্যের উচ্চমূল্য দীর্ঘ সময় ধরে পরিশোধ করতে হচ্ছে ক্রেতাদের।

প্রাথমিকভাবে এই ঘটনাগুলো দ্বারা ইকোনমিক শক থেরাপির ক্ষেত্র তৈরি করা হচ্ছে। যার ফল হিসেবে আসতে যাচ্ছে স্ট্যাগফ্লেশন।

এই ‘ইকোনমিক শক থেরাপির’ মূল কারণ হলো, সাম্রাজ্যবাদীদের লক্ষ্য থাকে তাদের পাপেট রেজিমে প্রথমেই সেই দেশের অর্থ ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়া এবং পরবর্তীতে দেশের অর্থনীতির উপর সরকারের সকল নিয়ন্ত্রণ সুকৌশলে তুলে নিয়ে প্রাইভেট সেক্টরের উপর তা তুলে দেওয়া। একই সাথে চলতে থাকে, পরিস্থিতিতে ফেলে বিভিন্ন আনপ্রোডাক্টিভ খাতে বড় অংকের ঋণ নিতে বাধ্য করা। এর ফলে যা দাঁড়ায়, দেশের অর্থনীতি ভেঙে পরে পাশাপাশি সরকারের হাতে অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ আর থাকে না। পরিণামে ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশটির আর তাদের কথা শোনা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না, তা যে মতাদর্শের সরকারই দেশ চালাক না কেনো। দেশটি বেশ লম্বা সময়ের জন্য হয়ে যায় তাদের নিচু শ্রেণীর দাস। দেশটির যেকোন প্রাকৃতিক সম্পদ তারা দখল নিতে পারে, দেশটির ভূমি ব্যবহার করতে পারে যেকোন ভূ-রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে।

স্ট্যাগফ্লেশন একটি বিরল ও ভয়ংকর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। এর ফলে তৈরি হবে উচ্চ বেকারত্ব একই সাথে জিনিসপত্রের উচ্চমূল্য। ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের আইএমএফের সর্বশেষ ফোরকাস্টে তাদের আগের অনুমান থেকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমবে ২.১ শতাংশ ( পাঁচ মাস আগে ছিলো ৬.৬% আর এখন তা ৪.৫%) অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি বাড়বে ৩.৫ শতাংশ ( পাঁচ মাস আগে ছিলো ৭.২% আর এখন তা বেড়ে হয়েছে ১০.৭%)। রিসেটবাবার দল একটা লম্বা সময়ের জন্য বাংলাদেশকে তাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের দাস বানানোর নিমিত্তে অতি সুকৌশলে স্ট‍্যাগফ্লেশনের ফাঁদে ফেলতে চাচ্ছে। তারাই এদেশে প্রয়োগ করছে আমেরিকান প্রেসক্রিপশনের ‘ইকোনমিক শক থিওরি’। বাংলাদেশ কি তবে দীর্ঘ সময়ের জন্য পশ্চিমা স্বার্থের বলি হতে যাচ্ছে সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাক কিংবা অন্য পাপেট রেজিমের দেশগুলোর মতো নাকি পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ বিচিত্র জনগোষ্ঠীর এই ভূমি তৈরি করবে সবচেয়ে দ্রুততম সময়ে সাম্রাজ্যবাদীদের কূটচাল থেকে বের হয়ে আসার নতুন ইতিহাস? উত্তরটা সময়ই বলে দিবে।

#ATeam 20241071

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *