শীলা। হেড স্যারের মেয়ে। আমাদের রোল পাশাপাশি, আমার দুই, তার এক। ক্লাসেও আমরা পাশাপাশিই বসতাম। একদিন দেখলাম শীলা নেই ক্লাসে। খুঁজতে খুঁজতে যেয়ে দেখি শীলা ক্লাস এইটের রুমে সিনিয়রদের সাথে ক্লাস করছে।
আমাকে দেখে শীলা ক্লাস থেকে বের হয়ে এসে জানালো, গতকাল রাতে আমার একখান প্রেমপত্র দুর্ভাগ্যক্রমে তার বাবা দেখে ফেলেছে। যেখানে আমি শীলাকে লিখেছিলাম, আমরা একসাথে মেট্রিক পাশ করে প্রথমে পালিয়ে বিয়ে করবো, তারপর দূরের কোনও কলেজে ভর্তি হবো। আর এই পত্রের কারণেই তার বাবা তারে আজ সিক্স থেকে দুই ক্লাস লাফ দিয়ে এইটে ভর্তি করে দিয়েছে!
আমি ভাঙ্গা বুক নিয়ে সেই দিন আর ক্লাস করতে পারিনি। বাড়িতে যেয়ে বাবারে বললাম, শীলার বাবা শীলাকে ক্লাস এইটে ভর্তি করে দিছে, তুমিও আমারে এইটে ভর্তি করে দাও। শীলা সম্পর্কে জানতে চাইলে বাবাকে বললাম, হেড মাস্টার কৃষ্ণ স্যারের মেয়ে, খুব ভালো ছাত্রী। বাবা হা না কিছুই বললেন না, টুপিটা মাথায় দিয়ে বের হয়ে গেলেন। পরদিন আমারে ধরে নিয়ে তিন মাইল দূরে আরেক স্কুলে ভর্তি করে দিলেন, তাও আবার ক্লাস সিক্সেই!
স্কুল লাইফে শীলার সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিল শীলা প্রথমবার মেট্রিক ফেল করার পর। ওর চোখ ছলছল করছিলো। বললাম, এখন তোমার হেড মাস্টার বাবা বুঝবে, দুই ক্লাস লাফ দিলে কি হয়! পড়াশোনা এত সহজ না!
শুনেছি শীলা পরের বারও মেট্রিক ফেল করায় তার বাবা তারে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিছে। পরে প্রাইভেটে পড়াশোনা কিছুটা করেছে মর্মে জেনেছি। তারপর আর খবর পাইনি।
আজ প্রায় তিরিশ বছর পর শীলার সাথে দেখা। জিলা স্কুল অডিটোরিয়ামে সামনের সারিতে বসে শীলা। খুব একটা বুড়িয়ে যায়নি। আগের মত চুপচাপ, পরিপাটি। দু’একবার চোখাচোখি হলেও কথা হয়নি এখনও। আমি এসেছিলাম শিক্ষাবোর্ড থেকে স্কুল পরিদর্শনে। পরিদর্শনের এক ফাঁকে স্কুল কর্তৃপক্ষের অনুরোধে তাদের এক শিক্ষিকার অবসরোত্তর বিদায় অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হতে হলো।
স্টেজে বসে নিজের বুকের ধুকধুক নিজেই শুনতে পাচ্ছি। শীলাকে আমি পছন্দ করতাম, প্রচন্ড ভালোবাসতাম। আজও ভালোবাসি। কিন্তু শীলা তো কখনোই কিছু বলেনি, রিপ্লাইও দেয়নি। আস্ত একটা দেমাগী। বাপে চাইলো আর সে সুরসুর করে আমাকে ছেড়ে এক লাফে সিক্স থেকে এইটে উঠে গেলো, বিয়েও করে ফেলল!! কিন্তু শীলা এই স্কুলে কী করে? নিশ্চয় তার ছেলেপুলের গার্জিয়ান হিসেবে অনুষ্ঠানে এসেছে।
না, প্রথম বক্তার বক্তব্য থেকে এরমধ্যে বুঝে ফেলছি আজ শীলারই বিদায় সম্বর্ধনা। শীলাই সেই অবসরগামী শিক্ষিকা। তার মানে, শীলা পড়াশোনা চালিয়ে গেছে! ইন্টারেস্টিং! সামনে বসা শীলা মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা লিখছে। বিদায়ী বক্তব্য গুছিয়ে নিচ্ছে হয়তো।
অবশেষে শীলা চক্রবর্তী স্টেজে এলেন, তার বিদায়ী ভাষণ দিতে। এ ধরনের বিদায় সবসময় কষ্টের হয় জানি। কিন্তু শীলা আজ ব্যতিক্রম কেন! মনে হচ্ছে, অবসরে যেতে পেরেই খুশী!
অনুষ্ঠান শেষে শীলা এক ফাঁকে কাছে এসে দাড়ালো। বললাম, কেমন আছো শীলা? শীলা প্রশ্নের জবাব না দিয়ে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললো, এখানে বসে লিখেছি। পরে পড়ে নিও, সব জবাব আছে।
ঢাকার উদ্দেশ্যে গাড়িতে উঠে বসছি। কী আর লিখবে শীলা! কিছু বাহানা হয়তো..
….. কখনও তোমাকে লিখিনি। আজকেও লিখতাম না। কিন্তু, মনে হলো তুমি অনুষ্ঠান শেষে নানান প্রশ্ন করবে, অনেক প্রশ্নের উত্তর চাইবে, তাই এই লেখা।
বাবা জোর করে বিয়ে দিলেও লোকটাকে কেন যেন ভালোই লাগেনি, ভালো লাগানোর চেষ্টাও করিনি। পরের বছর বাবা মারা গেলে লোকটাকে ডিভোর্স দিয়ে দেই। একসময় যখন স্কুলে চাকরিটা হয়, স্কুলের বাচ্চাকাচ্চারাই আমার সংসার হয়ে ওঠে। বাসায়-স্কুলে ওরাই আমার সব। আর বিয়ের চিন্তা মাথায় আসেনি।
অনুষ্ঠানে আমার উদ্দেশ্যে মাহি নামের যেই ছেলেটা বক্তব্য দিয়েছে, ওর মা নেই, হোস্টেলে থাকে। আমি প্রতিদিন ওর জন্য টিফিন নিয়ে যাই, আমাকে মা ডাকে।
আজ সকালে মাহি এসে কাঁদতে কাঁদতে বললো, মা, ছাত্ররা তোমারে পদত্যাগ করানোর জন্য জড়ো হচ্ছিলো। আমি আটকিয়েছি। ওরা এখন শর্ত দিয়েছে তুমি সেচ্ছায় অবসরে গেলে সসম্মানে তোমারে বিদায় দেবে, অপমান করবে না। আমি মাহিকে খুশী খুশী হাঁ বলে দিয়েছি।
তুমি হয়তো ভাববে, অনুষ্ঠানে হঠাৎ তোমাকে পেয়েই আমি হয়তো এত প্রফুল্ল ছিলাম। একদম না। আমি খুশী কারণ আমার স্নেহের ছাত্ররা, আমার সন্তানরা আমাকে অপমান থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। তবে মাহির জন্য একটু চিন্তা হয়, কবে না আবার এই হিন্দু শিক্ষিকাকে মা ডাকার জন্য তাকেও.. !
আমি জানি তুমি আমাকে খুব ভালোবাসো। হাজারবার জানতে চাইতে, আমি তোমাকে ভালোবাসি কি না। জবাব দেই নি।
মনে পড়ে তুমি বলে ছিলে, আমরা একসাথে মেট্রিক দিয়ে পালিয়ে যেয়ে বিয়ে করবো। বাবা বুঝতে পেরে আমাকে দুই ক্লাস সিনিয়র বানিয়ে দিলো, যাতে একসাথে মেট্রিক পাশ না করে তোমার দুই বছর আগে পাশ করে ফেলি।
তোমাকে ভালোবাসি কিনা জানি না, তবে তোমার আগে দুইবার মেট্রিক পরীক্ষায় বসে ফেল করেছি, কারণ খাতায় ইচ্ছে করেই কিছু লিখিনি, লিখতে পারিনি। তবুও কি বলবে ভালোবাসি নি?
#ATeam 20241120