লাল-নীল সেলিব্রেটি ও বাংলাদেশের রাজনীতি

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বুলি হওয়া ২ জন সেলিব্রেটি হলেন আজমেরী হক বাঁধন এবং মেহজাবীন চৌধুরি। আজমেরী হক আওয়ামী লীগের আমলে পদ্মাসেতুর বিজ্ঞাপন করেছেন, সরকারের গুডবুকে ছিলেন; কিন্তু জুলাইয়ের আন্দোলনের সময় হঠাৎ ভোল পাল্টে ফেলেন। মেহজাবীন চৌধুরিও তাই। আওয়ামী লীগের শাসনামলে তিনি প্রস্ফুটিত হয়েছেন, প্রথম আলোর গুডবুকে ছিলেন, কখনো শুনি নি তার কাজ করতে কখনো অসুবিধা হয়েছে। কিন্তু ৫ই আগস্ট তিনি নিজেকে “স্বাধীন” ঘোষণা করেন। সেই স্বাধীন তিনি যখন চট্টগ্রামে সামান্য একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান উদ্বোধন করতে পারেন নি নারী হওয়ার কারণে, তখন ক্ষিপ্ত ফেসবুক ব্যবহারকারীরা তাকে বুলি করেছেন।

সত্যিকার অর্থে, আমি জুলাই আন্দোলনের সময় অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করেছি একদল “সেলিব্রেটি” সরকার উৎখাতের আন্দোলনে একদম সামনের সারিতে এসে গেছেন। আওয়ামী লীগ আমলে মোশাররফ করিম কয়েক হাজার নাটক করেছে। এই ভদ্রলোকের নাটকের সংখ্যা দেখে আমি ভাবতাম, এতো কাজ করে ইনি ঘুমান কখন! আওয়ামী লীগের ওপর পেশাগতভাবে তার কোনো রাগ থাকার কথা না। তিনিই মাইক হাতে আন্দোলনে নেমে গিয়েছিলেন। লীগের ওপর এরকম রাগ থাকতে পারে কাজী নওশাবার। গুজব ছড়ানোর কারণে আওয়ামী লীগের আমলে তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন। প্লেবয় সালমান মুক্তাদিরেরও কিছু ক্ষোভ থাকতে পারে। জব্বার কাকু একবার তার কান মলে দিয়েছিলেন। কিন্তু মোস্তফা সারোয়ার ফারুকির মতো গণভবনের লোক কিভাবে এতো কট্টোরভাবে হাসিনাবিদ্বেষী হয়, সেই সমীকরণ মেলানো কঠিন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বানানো সিনেমায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মহিলা চরিত্র দেয়া হয়েছিলো তিশাকে।

৫ই আগস্টের পর একসময় সামনে আসে “আলো আসবেই” হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের কথা। সেখানে আবার আওয়ামী লীগ সমর্থক সেলিব্রেটিরা আলোচনা করছেন কিভাবে আন্দোলন দমানো যায়। বহুরূপি সেলিব্রেটিদের কেউ আবার সেই চ্যাট ফাস করেও দিয়েছেন, যাতে আলো আসবেই গ্রুপ হেনস্তার শিকার হয়।

আওয়ামী লীগ আমলে সবচেয়ে বিরক্তিকর বিষয় ছিলো সেলিব্রেটিদের নমিনেশন প্রার্থনা। পলিটিশিয়ানদের জন্য পলিটিক্স ডিফিকাল্ট করা জিয়া নীতির আমি ঘোর বিরোধী। একই কথা ৫ই আগস্টের পর স্বল্পকালীন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সামরিক সাখাওয়াতও বলেছিলেন, “এখন থেকে রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করা হবে”। কিন্তু এটি আওয়ামী লীগের আদর্শের সাথে যায় না। আমি সংসদে রাজনীতি করা মানুষজনকেই দেখতে চাই। তারা জনগণের সাথে মিশে অভ্যস্ত, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার সাথে পরিচিত। আমি তারিন-সুবর্ণাদের নাম উল্লেখ করতে চাই না; কিন্তু মূল সংসদ নির্বাচনে নমিনেশনের সময় এবং এরপর একদম ফ্রি সংরক্ষিত আসনে বসার জন্য এদের দৌঁড়ঝাঁপ দেখে যারপরনাই বিরক্ত হয়েছি। সেলিব্রেটিদের রাজনৈতিক এফিলিয়েশন থাকতেই পারে, সেটা সমস্যা না। কেউ রাজনীতি করে এসে পদে বসুক, আমি ১০০% সমর্থন করবো। কিন্তু উড়ে এসে জুড়ে বসা দুধের মাছিরা দুধ ফুরালেই আবার উড়ে যাবে, জনগণ বা দলের প্রতি তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। সেলিব্রেটিরা লাল-নীলে বিভক্ত হওয়ার একটা কারণ থাকতে পারে এরকম পদপ্রত্যাশার। আমি যদি মোশাররফ করিম হয়ে নমিনেশন চাইতাম;কিন্তু পেতাম না, পেয়ে যেতো ফেরদৌস, তাহলে আমিও হাসিনার ওপর হয়তো বিলা হতাম।

তবে জুলাই আন্দোলনে সেলিব্রেটিদের একাংশ যেভাবে আওয়ামী লীগের বিপক্ষে অ্যাকশনে নেমেছে, সেই লেভেলের বিলা হতে অন্য কিছু দরকার। সেই অন্য কিছুটা হলো টাকা। অনেক অনেক টাকা। এই সেলিব্রেটিরা ছিলেন সরকার পতনের দীর্ঘমেয়াদী মেটিকুলাস পরিকল্পনার অংশ। আশফাক নিপুনের মহানগর সিরিজ এমনি এমনি আসে নি, মোশাররফ করিমও সেখানে এমনি এমনি ওসি হারুন হয়ে দুর্দান্ত অভিনয় করেন নি। এই পরিকল্পনার কিছুটা আভাস পাওয়া যায় আমেরিকার “ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিক ইনস্টিটিউট” (আইআরআই)-এর কাজকর্মে, তাদের প্রতিবেদনে। বাংলাদেশের রাজনীতিকে অশান্ত করতে তারা দীর্ঘদিন কাজ করেছে। এ কাজে যোগ্যতা আছে, জনগণের কাছে “হিট” আছে, এরকম লোকজনকে বাছাই করে ট্রেনিং দিয়েছে, তাদের প্ল্যান এক্সিকিউট করেছে।

তারা রিপোর্ট করেছে, “… identified over 170 democratic activists who would cooperate with IRI to destabilize Bangladesh’s politics” সারজিস, হাসনাতের মতো বাকপটু বিতার্কিকরা এরকম অ্যাকটিভিস্টের উদাহরণ। মাস্টারমাইন্ড অবশ্যই এরা নয়। মাস্টারমাইন্ড হলো আইআরআইয়ের ফান্ডের যোগানদাতারা, যেমন, ইউনূস, জামায়াত। কিন্তু এই অ্যাকটিভিস্টরা হলো পাবলিক ইন্টারফেস, রাজনীতিকে অশান্ত করতে জনসংযোগ এদের দায়িত্ব।

আইআরআই আরো রিপোর্ট করেছে, “IRI held a workshop titled “Art and Activism in Bangladesh,” which brought together a diverse group of artists to discuss the challenges they face; their target audiences and how they can reach these audiences through art; and how artists can collaborate on socially conscious art campaigns to engage more people in political change. The workshop engaged 21participants. Participants represented different divisions and mediums of art.”

“IRI and ArtLords held a Zoom workshop titled “Art Infused with Action Lab,” which engaged 62 young artists and activists from across Bangladesh and focused on how art can be used as a tool for social and political change.”

অর্থাৎ রেজিম পরিবর্তনের জন্য এভাবে সেলিব্রেটিদেরকে ব্যবহারের কথা এদের রিপোর্টেই আছে। তথ্যের ভারে পাঠককে আর ভারাক্রান্ত না করেই বলা যায়, মোশাররফ করিমরা এমনি এমনি মাইক হাতে বেরিয়ে পড়েন নি। ফারুকি, বাঁধনরা এমনি এমনি সুর পাল্টান নি, মেহজাবীন এমনি এমনি “স্বাধীন” হয়ে যান নি। তারা কাজটা করেছেন টাকার বিনিময়ে। টাকা নিয়েছেন, সার্ভিস দিয়েছেন। এ কাজে তাদের পলিটিক্যাল এফিলিয়েশন খুব একটা প্রভাব ফেলে নি বলেই আমার মত।

এখন আসি, সম্প্রতি এরকম বিভিন্ন সেলিব্রেটি যে “স্বাধীনতা” উপভোগ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন, তার কারণ অনুসন্ধানে। কারণটি আসলে খুব জটিল কোনো সমীকরণ নয়। মনে করেন, আপনি টাকার বিনিময়ে কারো সার্ভিস কিনলেন। এরপর সেই সার্ভিসের মাধ্যমে আপনি আপনার উদ্দেশ্যটিই বাস্তবায়নের চেষ্টা করবেন। সার্ভিস বিক্রেতার ভালোমন্দ দেখার দায়বদ্ধতা আপনার নেই। বর্তমান রাজনীতির কনটেক্সটে বিষয়টি ফিট করেন। জামায়াত-হিজু-ইউনূস ইত্যাদিরা আওয়ামী লীগ সরকারকে ফেলতে বাঁধন-মেহজাবীনদের সার্ভিস কিনেছেন। তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ বাংলাদেশে উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদ প্রতিষ্ঠা করা। সেই বাংলাদেশে নারীর কোনো স্বাধীনতা থাকবে না। এমন না যে, ব্যক্তি মেহজাবীনের ওপর জ’ঙ্গী গংয়ের কোনো আক্রোশ আছে। মেহজাবীনের পরিবর্তে অন্য যে কোন নারী সেলব্রেটিই শোরুম উদ্বোধনে “তৌহিদি” জনতার বাধার মুখে পড়তেন। তিশাও।

বাংলাদেশকে যারা সিরিয়া-আফগানিস্তান হিসেবে দেখতে চান না, সেসব সাধারণ মানুষ টাকার বিনিময়ে ভাড়া খাটা এসব লালবিপ্লবীদের প্রতি বিলা হতে পারেন। সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু তার প্রকাশ সীমা ছাড়িয়ে গেলে সমস্যা। বাংলাদেশ দুর্নীতি পরায়ণ দেশ। এটি প্রথমেই আপনাকে মাথায় রাখতে হবে। অনেক অনেক টাকা পেলে আপনি নিজেও লালবিপ্লবে শরীক হতেন কি না, সেটিও চিন্তা করে দেখবেন। নিজের কথা বলি, প্রচুর টাকা পেলে আমিও মোশাররফ করিমের মতো মাইক হাতে বের হয়ে পড়তাম, বিশেষ করে যদি বুঝতে অসমর্থ হতাম, আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ইউনূসের জঙ্গীবাদের বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অনেক ঘাঁগু রাজনীতি সচেতন লোকজনই সেটি বুঝতে অসমর্থ হয়েছেন, এখন আপনি যদি আশা করে থাকেন, মেহজাবীন সেটি তখন বুঝে ফেলবেন, তাহলে আপনি মেহজাবীনকে আইনস্টাইন ভেবে বসেছেন।

সুতরাং লালবিল্পবী সেলিব্রেটিদের প্রতি আমাদের সফট থাকতে হবে। সাধারণ জীবনে তাদেরকে ফিরে আসার সুযোগ দিতে হবে। জ’ঙ্গীবাদের খপ্পর থেকে বাংলাদেশকে উদ্ধার করা হবে অচিরেই। ইউনূসের জারি করা কোনো ইনডেমনিটি তাদেরকে বেশিদিন রক্ষা করতে পারবে না। বাংলার মানুষই আন্দোলন করে তাদেরকে তাড়াবে। সেই আন্দোলনে মেহজাবীনদেরকেও অংশ নেয়ার সুযোগ দিন। এবার তারা মুখ খুলবেন ভুল শোধরাতে, দেশকে শত্রুমুক্ত করতে, কোনোরকম পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নয়।

#ATeam 20241122

0 thoughts on “লাল-নীল সেলিব্রেটি ও বাংলাদেশের রাজনীতি”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *