ড. ইউনূসের মাস্টারমাইন্ড মাহফুজ আলম সম্প্রতি বেশজগাখিঁচুড়ি পাঁকিয়ে “পালনবাদ” তত্ত্ব হাজির করেছে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের কাছেই শব্দটা অপরিচিত হওয়ায় এবং মাহফুজ আলম যথারীতি তার জড়ানো অগোছালো বক্তব্যে বিষয়টা বুঝাতে না পারায় লোকজন হাসাহাসি করেছে। বেশিরভাগ মানুষের মতোই এই “বাদ”টি আমার কাছেও অপরিচিত ছিলো। তাই একটু খুঁজে দেখলাম, এবং খুঁজে যা বুঝতে পারলাম, সেটিই আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করি।
“পালনবাদ”-এর প্রবক্তা কে, সেটি খুঁজে নিশ্চিত হওয়া কঠিন। তবে এটি মাহফুজ আলমদের কাছে প্রিয় করেছেন মাওলানা ভাসানী। ভাসানীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দর্শন ছিলো রবুবিয়ত। ‘রবুবিয়ত’ শব্দের বাংলা অর্থ বলা যায় ‘রাষ্ট্রীয় পালনবাদ’। আল্লাহ সমগ্র বিশ্ব এবং সকল জীবনের প্রতিপালক। যারা দেশ শাসন করবে, তারা হবে জনগণের প্রতিপালক। আল্লাহ যেমন ন্যায়বিচারের মাধ্যমে সকল জীবের মধ্যে সম্পদ বন্টন করেন, রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠীও তেমনি জনগণের মধ্যে সম্পদ বন্টন করবে, প্রতিপালন করবে। উপর থেকে দেখলে মূল উদ্দেশ্য খারাপ না। অনেকটা সমাজতন্ত্রের মতো। সমস্যা হলো, প্রথমত সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব যা-ই থাক, তার বাস্তব প্রয়োগ এতো বেশি ত্রুটিপূর্ণ যে, সমস্ত ক্ষমতার উৎস হয়ে ওঠে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী, বাদবাকি জনগণের এমনকি মৌলিক অধিকারও হরন করা হয়। আইনই এমন যে, অভিযোগ করার সুযোগও থাকে না। ভাসানী আবার এর সঙ্গে ধর্মের ঘুঁটা দিয়ে বিষয়টাকে আরো জটিল করে ফেলেছেন।
ভাসানীর উদ্দেশ্য যা-ই থাক, মাহফুজ আলমদের মতো জ-ঙ্গীরা ইসলামের অপব্যাখ্যা করে কিভাবে মানুষের ওপর অত্যাচারের রাজত্ব কায়েম করে, তার উদাহরণ এই “পালনবাদ”। এক্ষেত্রে তারা কুরআনের কয়েকটা আয়াতের রেফারেন্সকে টুইস্ট করে “নিজেদেরকে” আল্লাহর প্রতিনিধি বা খলিফা হিসেবে দাবি করে এবং বাকি মানুষের ওপর তাদের শাসনকে চাপিয়ে দেয়। যেমন,
(কুরআন, ৬:১৬৫) “তিনিই তোমাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছেন এবং একে অন্যের উপর মর্যাদা সমুন্নত করেছেন …”
এটি দেখিয়ে তারা বলতে চায়, “তারা” আল্লাহর প্রতিনিধি, সাধারণ মানুষের তুলনায় আল্লাহর কাছে তাদের মর্যাদা বেশি, সাধারণ মানুষ লোয়ার কাস্ট, তাদের অনুগ্রহের পাত্র। তাই সাধারণ মানুষের প্রতি সিমপ্যাথী দেখিয়ে তারা শাসন করবে।
বস্তুত, প্রতিনিধি বলতে আল্লাহ সমস্ত মানুষকে বুঝিয়েছেন, মাহফুজ আলমকে তো না-ই, এমনকি নির্দিষ্ট কোনো নবী-রাসূলকেও না। যেমন,
(কুরআন, ২:৩০) “আর তোমার পালনকর্তা যখন ফেরেশতাদিগকে বললেনঃ আমি পৃথিবীতে একজন প্রতিনিধি বানাতে যাচ্ছি, তখন ফেরেশতাগণ বলল, তুমি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে সৃষ্টি করবে যে দাঙ্গা-হাঙ্গামার সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত ঘটাবে? …”
স্পষ্টতই এখানে আল্লাহর প্রতিনিধি সমস্ত মানুষই। কিন্তু “নিজেদেরকে” রেখে বাকি সব মানুষকে খারিজ করে দিতে এরা আরেকটি আয়াতের অপব্যাখ্যা করে। যেমন,
(কুরআন, ৩৫:৩৯) “তিনিই তোমাদেরকে পৃথিবীতে স্বীয় প্রতিনিধি করেছেন। অতএব যে কুফরী করবে তার কুফরী তার উপরই বর্তাবে। কাফেরদের কুফর কেবল তাদের পালনকর্তার ক্রোধই বৃদ্ধি করে এবং কাফেরদের কুফর কেবল তাদের ক্ষতিই বৃদ্ধি করে।”
এখানে মাহফুজ আলমরা বলতে চায়, একমাত্র তারাই সঠিক পথে আছে, বাকি সব কাফির। সুতরাং তারা আর আল্লাহর প্রতিনিধি না। স্পষ্টতই কোনো মানুষ আল্লাহর ওপর ঈমান না আনলেও আল্লাহ তাকে প্রতিনিধি হিসেবে খারিজ করে দিচ্ছেন না। তাকে শুধু আল্লাহর নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। সংশোধনের সুযোগ দিচ্ছেন। আল্লাহর সৃষ্ট সবচেয়ে বুদ্ধিমান জীব হয়েও তারা কেন আল্লাহ থেকে বিমুখ হচ্ছে, এতে তাদের ক্ষতি হবে ইত্যাদি। প্রশ্ন হলো, কে ঈমানদার আর কে ঈমানদার নয়, সে বিচারের ভার একমাত্র আল্লাহর। এখন কেউ যদি নিজেই সেই জাজমেন্টের ভার নেয়, স্পষ্টতই সে শিরকের মতো পাপ করার ঝুঁকিতে পড়ে। নিজেদেরকে ঈমানদার এবং অন্যদেরকে কাফির বা লোয়ার কাস্টের আম-জনতা ট্যাগ দিয়ে তাদের “প্রতিপালক” হওয়ার ঘোষণার মাধ্যমে মাহফুজ আলমরা শিরকের ঝুঁকি নিচ্ছে।
এখন আমরা যদি ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাই, তাহলে বারবার দেখতে পারবো, ইতিহাসের সব জুলুমবাজ শাসকই নিজেদেরকে প্রতিপালক ঘোষণা দিয়ে মূলত মানুষকে অধিকার বঞ্চিত করেছে। মাহফুজ আলমদের পালনবাদের সাথে এরকম সবচেয়ে বেশি মিল পাওয়া যায় ফেরাউনদের। আমাদের একটা ভুল ধারণা আছে যে, সব ফেরাউনই নিজেকে “সৃষ্টিকর্তা” হিসেবে দাবি করতো। আসলে তারা নিজেদেরকে সৃষ্টিকর্তা নয়, “পালনকর্তা” হিসেবে দাবী করতো। তারাও আল্লাহ-ঈশ্বর-ভগবান যে নামেই সৃষ্টিকর্তাকে ডাকুন, তাকে বাতিল করে নাই। কিন্তু মানুষের কাছ থেকে তাকে ডিসকানেক্ট করেছে। অর্থাৎ, ফেরাউনরা নিজেরাই স্রষ্টার প্রতিনিধি এবং স্রষ্টার কাছে কোনো মুনাজাত থাকলে আমজনতাকে তা পৌঁছাতে হবে ফেরাউনের সিস্টেমের মাধ্যমে। কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে স্রষ্টার নাগাল পাওয়া সম্ভব নয়, এটাই ছিলো তাদের নীতি। এই লেখায় আমি একে বলবো “ফেরাউনবাদ”।
ফেরাউনদের সিস্টেমে একটি বিশাল হায়ারার্কি ছিলো। যার একেবারে উপরের স্তরে ছিলো রাজা অর্থাৎ ফারাও নিজে। তার পরের স্তরে ছিলো উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন পাদ্রীরা। সৃষ্টিকর্তার সাথে ডিরেক্ট কানেকশন ছিলো শুধুমাত্র ফেরাউনের নিজের, বা কোনো কোনো ফেরাউনের সময় তার উচ্চ লেভেলের পাদ্রীদেরও। এমনকি উপসনালয়ে যাওয়ার অধিকারও ছিলো শুধুমাত্র ফেরাউন ও তার পাদ্রীদের। পর্যায়ক্রমে আরো কয়েকটি শ্রেণি ছিলো, আর্মি, রেকর্ড কিপার, শিল্পী। একদম নিচের স্তরে ছিলো কৃষিকাজ করা সাধারণ মানুষ এবং দাসগণ। কয়েক হাজার বছরের ফেরাউন শাসনামলে অবশ্যই এই হায়ারার্কি একটু এদিক-সেদিক হয়েছে; কিন্তু মোটাদাগে মানুষকে শোষণ করার উপায় হিসেবে তারা এটি সৃষ্টি করেছিলো। এমনকি সৃষ্টিকর্তার ইবাদত বা আরাধনা করার সরাসরি কোনো উপায়ও তারা রাখে নি।
স্পষ্টতই, ধর্মের বিচারে মানুষের মধ্যে ইসলাম এরকম কোনো হায়ারার্কি প্রথা সমর্থন করে না; বরং সকল মানুষই আল্লাহর দৃষ্টিতে সমান, এই সাম্যবাদই ইসলাম শিক্ষা দেয়। মানুষ ব্যক্তিগত, সামাজিক, পেশাগত জীবনে বিভিন্ন যোগ্যতার জন্য বিভিন্ন মর্যাদার অধিকারী হয়। ইসলাম সেই মর্যাদাকে অস্বীকার করে না। কিন্তু পৃথিবীতে ধর্মের বিচারে সবাই সমান। একজন কৃষক আর ড. ইউনূস নামাজে একই কাতারে দাঁড়াবেন (যদি ইউনূস কখনো নামাজ পড়েন আর কী!), এটিই ইসলামের শিক্ষা। কেউ যদি পরহেজগার না হয়, তার বিচার একমাত্র আল্লাহই করবেন। সেই বিচারের ভার আমি আপনি করতে গেলে আমরা নিজেরাই পাপী হবো।
ইসলামে সমগ্র মানুষের পালনকর্তা একমাত্র আল্লাহ। তিনি অন্য মানুষকে লালন-পালন করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট বাহিনীকে সার্টিফিকেট হাতে ধরিয়ে দায়িত্ব দিয়ে পৃথিবীতে পাঠান নি। কেউ প্রধানমন্ত্রী হলে, কেউ রাষ্ট্রপতি হলে, কেউ স্কুল শিক্ষক হলে, সেক্ষেত্রে যার যার পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে হবে। সেই দায়িত্ব পালন আর পালনবাদের পালন এক জিনিস নয়। ফেরাউনবাদ গণতন্ত্রেও অচল, ধর্মেও চলে না।
বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে প্রত্যেকটি মানুষেরই সমান অধিকার। আইনের অপপ্রয়োগ, শাসকগোষ্ঠীর নির্যাতনের বিরুদ্ধে যেখানে আমাদের সর্বজনীন, সার্বক্ষণিক লড়াই চলমান, সেখানে একটি ফেরাউনবাদকেই আইনে পরিণত করার চিন্তা সুস্থতা নির্দেশক নয়।
#ATeam 20241166