কথায় আছে, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। তবে রাজনীতি যে কতোটা ডায়নামিক বিষয়, সেটি এই এক উক্তি পুরোটা ধারণ করতে পারে না। এজন্যই রাজনীতিতে ভবিষ্যতে কী হবে, তা প্রেডিক্ট করা খুব কঠিন। তবে ঝানু পলিটিশিয়ানরা সময় এবং পরিস্থিতির সাথে সাথে নিজেদের কর্মপদ্ধতি অভিযোজন করেন। অভিযোজন করেই টিকে থাকেন। অথবা পরিস্থিতি খুব প্রতিকূলে গেলে অভিযোজনের চেষ্টা করেও সফল হওয়া যায় না।
অনেকে মনে করেন, ড. ইউনূস রাজনীতিতে অজ্ঞ। তাদের কথায় কিছুটা সত্যতা আছে। কারণ, ড. ইউনূস গণমানুষের সঙ্গে মিশতে পারেন না। গণমানুষ থেকে তিনি যে উঁচু শ্রেণির কুলীন, সেটি লুকোবারও তেমন চেষ্টা করেন না। তবে আমার বিবেচনায় মানুষ যা মনে করে রাজনীতির হিসেবে তিনি তার চেয়ে অনেক দক্ষ। রাজনীতিতে টিকতে হলে সবসময় গণমানুষের মাথায় হাত বুলানোর দরকার না। বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় নেত্রী খালেদা জিয়াই তার প্রমাণ। মানুষের মাথায় হাত বুলিয়ে শেখ হাসিনা যেমন সফল, মানুষের মাথায় হাত না বুলিয়েও খালেদা জিয়া সফল। ১৬ বছর পরে হলেও ড. ইউনূস বাংলাদেশের ক্ষমতার চেয়ারে বসতে পেরেছেন, রাজনীতিবিদ হিসেবে তাকেও অসফল বলা অন্যায় হবে।
একজন সফল রাজনীতিবিদের অভিযোজন ক্ষমতাও ড. ইউনূসের আছে, এটি তিনি প্রমাণ করে যাচ্ছেন। ক্ষমতার মসনদে বসে তার Plan A ছিলো যতো বছর সম্ভব ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং সেটি কোনোভাবেই ৫ বছরের কম নয়। আগেরবার ওয়ান ইলেভেনের আমলেও তার এমনটাই দাবী ছিলো। তিনি যে সংস্কার সংস্কার করেন, আমেরিকার পুতুল হওয়ার পরেও আমি মনে করি আগেরবার তার মাথায় আসলেই সংস্কার করে ভালো কিছু করার পরিকল্পনা ছিলো। সেই ভালোটা হয়তো গণতান্ত্রিক রাজনীতির লাইনে যেতো না; কিন্তু মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কিছু ভাবনা তার মধ্যে ছিলো, সে বেনিফিট অফ ডাউট তাকে দেয়া যায়। কিন্তু গত ১৬ বছরে বিভিন্নভাবে তার হোলিয়ার দ্যান কাউ ইমেজ নষ্ট হয়েছে, আওয়ামী লীগ তার কাছা ধরে টান দিয়েছে। আর্থিক ও সামাজিক যেসব ছলচাতুরি করে তিনি তার ইমেজ বজায় রাখতেন, সেগুলোতে হাত পড়েছে। সুতরাং এবারের ক্ষমতায় আরোহন করে তার প্রথম এবং প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো প্রতিশোধ নেয়া। সে কাজে তিনি জামায়াতের সহযোগিতা পেয়েছেন, হেফাজতের সমর্থন পেয়েছেন, জ’ঙ্গীদের সহায়তা পেয়েছেন। এই গ্রুপগুলোও গত ১৫ বছরে বিভিন্ন কারণে আওয়ামী লীগের ওপর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছে।
ইউনূসের Plan A বাস্তবায়নের জন্যই তাকে জ’ঙ্গীসহ বাকি সন্ত্রাসীদেরকে কারাগারগুলো থেকে ছাড়তে হয়েছে, পুলিশ ফাঁড়ি লুট করে অস্ত্র দিতে হয়েছে। আওয়ামী লীগের ওপর গণহত্যা চালানোর প্রসেস শুরুও হয়ে গিয়েছিলো। Plan A-তে বিএনপি ছিলো না। কারণ, বিএনপি যেহেতু বিপুল জনসমর্থনযুক্ত একটি দল, তারা ইউনূসের গণহত্যার পরিকল্পনায় সায় দিবে না।
শুধু মানুষ হত্যাই নয়, গণহত্যার অন্যান্য উপকরণ, যেমন ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে আগুন, আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িতে আগুন, শিক্ষালয়গুলো থেকে আওয়ামী লীগ এবং হিন্দু (যাদেরকে বাই ডিফল্ট আওয়ামী লীগ হিসেবে কাউন্ট করা হয়) বিতাড়ন, প্রশাসন, পুলিশ, আর্মি সর্বস্তরে আওয়ামীদেরকে চাকরিচ্যুত করে ভাতে মারার ব্যবস্থা করা – সবকিছুই চলছিলো। মিডিয়ার সাধ্য নেই খবর প্রকাশের। সুতরাং, গণহত্যায় তেমন কোনো বাধা আসেনি। সমস্যা বাধায় আমেরিকার নির্বাচন। কমলা হ্যারিস হেরে যাবেন, এটি অপ্রত্যাশিত ছিলো। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ডোনাল্ড ট্রাম্প বাজিমাত করেন। এমন না যে, ট্রাম্প বাংলাদেশের নীতি বদলানোর ব্যাপারে খুব উৎসাহী। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী এখানে একটি ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ান এবং মোটামুটিভাবে ধরে নেয়া যায় যে, ট্রাম্প ক্ষমতায় বসার পর বাংলাদেশ বিষয়ে সিদ্ধান্ত বদলাবেন এবং ইউনূস গণহত্যা চালিয়ে টিকে থাকতে পারবেন না।
আমেরিকার নির্বাচনের পরেই ইউনূসের রিসেট বাটন টেপার আগ্রহে ভাঁটা পড়তে থাকে। বরং বিভিন্ন সময়ে ইউনূসকে এবং তার উপদেষ্টাদেরকে ভীতসন্ত্রস্ত মনে হয়েছে। মূলত ভয়কে জয় করার ব্যর্থ চেষ্টার অংশ হিসেবেই তারা ৫ই আগস্টের পর সশস্ত্র আন্দোলনের ডাক দিতো, দেশে গৃহযুদ্ধ বাঁধাবে, এরকম হুমকি-ধামকি দিতে শুরু করে। ইউনূসও বলতে শুরু করেন, উপদেষ্টারা অনেকেই তাকে ছেড়ে যেতে চান, তারা যে বেতন-ভাতা পান, তাতে তাদের বাচ্চাদের স্কুলের বেতনও নাকি হচ্ছে না। সত্য হলো, উপদেষ্টারা মন্ত্রীর সমান বেতন (মাসিক ১ লাখ টাকার ওপরে) এবং সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা (ফ্রি গাড়ি, ফ্রি বাড়ি, ফ্রি মেডিক্যাল, ফ্রি বিদেশভ্রমণসহ বিশাল তালিকা করা যাবে) পান। আরো সত্য হলো, উপদেষ্টাদের কার বাচ্চা যে স্কুলে পড়ে, সেটি আপনাকে দূরবীণ দিয়ে খুঁজতে হবে। কেউ বুড়ো, আবার কেউ একদমই তরুণ, স্কুলপড়ুয়া বাচ্চাওয়ালা উপদেষ্টা তাহলে কারা? উপদেষ্টারা তাদের স্বাভাবিক পেশাও একেবারে ত্যাগ করেছেন বলে শোনা যায় না। উপদেষ্টা হওয়ার পর ফারুকি কি আর সিনেমা-নাটক বানাবেন না? আসিফ নজরুল কি শিক্ষকতা থেকে ইস্তফা দিয়েছেন? নাহিদ-আসিফ-মাহফুজরা আগে বেকার ছিলেন, এখন মন্ত্রীর বেতনভাতা পাচ্ছেন, তদবির বাণিজ্য করে টাকা কামাচ্ছেন, ইউরোট্রিপ মারছেন। যাহোক, ইউনূস এই কথা বলার অর্থ হলো একটি ক্ষেত্র তৈরি করা। উপদেষ্টারা যখন পালাবেন, তখন যেন বলতে পারেন, বাচ্চার শিক্ষার ক্ষতি করে তো আর দেশের জন্য “ফিসাবিলিল্লাহ” সার্ভিস হিসেবে উপদেষ্টা থাকতে পারি না!
ট্রাম্প আসার পরেই মূলত ইউনূস ও উপদেষ্টারা Plan A পরিত্যাগ করে পালানোর প্ল্যানে যান। পালানোর জন্য অবশ্য বেশ কয়েকটি অপশন আছে। আমার মতে, Plan B ছিলো সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতা দিয়ে পদত্যাগ করা। সেই প্ল্যানে বেশ কয়েকটি অসুবিধা আছে। প্রথমত সেনাবাহিনীর ভিতরেই একাংশ চায় না পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্রক্ষমতায় বসতে। কেউ গণতন্ত্রের প্রতি সম্মান থেকে, আবার কেউ স্রেফ জাগতিক কারণে। আর্মি সরকারে বসলে বহির্বিশ্বে ভাবমূর্তি নষ্ট হবে, শান্তিরক্ষা মিশনের ইনকাম বন্ধ হয়ে যাবে। বিশেষ করে ভারত তখন কলকাঠি নেড়ে ট্রাম্প ও জাতিসংঘের মাধ্যমে ঝামেলা সৃষ্টি করবে। সুতরাং, ক্ষমতা নেয়ার ব্যাপারে তারা ঐক্যমত্যে পৌঁছাতে পারবে না। দ্বিতীয় সমস্যা বিএনপি। আওয়ামী লীগ ইউনূসের ওপর প্রতিশোধ নিতে মরিয়া। সাথে বিএনপিও মহাবিরক্ত হবে ইউনূস আর্মিকে বসিয়ে গেলে। তারা এটিকে মাইনাস টু হিসেবে কাউন্ট করবে। ইউনূস ও সমন্বয়কদেরকে নিজেরাও কিছু হেনস্তা করবে, আবার লীগকেও বাধা দিবে না। যারা দেশ ছেড়ে যেতে পারবে, তারা বাঁচবে। যারা পারবে না, তারা বিপদে পড়বে। প্রশ্ন উঠতে পারে, জিহাদের অস্ত্রগুলো কি তাদেরকে রক্ষা করতে পারবে? না। আর্মি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় জ’ঙ্গীরা অস্ত্র ব্যবহার করবে, এটি আর্মির প্রেস্টিজ ইস্যু হবে। আর অস্ত্র দিয়ে জনগণকে কতোদিন ঠেকিয়ে রাখা যাবে?
সুতরাং Plan B অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এরপর আসে Plan C. ইউনূস ও সমন্বয়করা বারবার বলে এসেছে আওয়ামী লীগও স্বৈরাচার, বিএনপিও স্বৈরাচার। বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য তারা মেটিকুলাস প্ল্যান করেনি। কিন্তু Plan C-তে বিএনপি আসতেই হবে। ইউনূস যদি কোনোমতে একটি নির্বাচন দিয়ে বিএনপিকে বসিয়ে দিতে পারে, তাহলে অনেকগুলো সুবিধা আছে। প্রথমত, বলতে পারবে সে ক্ষমতায় থাকতে চায়নি, নির্বাচন দিয়েই সরে পড়েছে। সংস্কারের মহান দায়িত্ব এখন বিএনপির। বিপুল জনসমর্থন থাকার কারণে বিএনপি উপদেষ্টা ও সমন্বয়কদেরকে পালাতে বা এমনকি বাংলাদেশেও অবস্থান করতে দিতে সমর্থ হবে। আওয়ামী লীগ ব্যস্ত থাকবে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি এই বিষয়ে মিছিল মিটিং করতে, উপদেষ্টাদের প্রতি আক্রমণাত্মক হওয়া কঠিন হবে। সাথে থাকবে বিএনপির প্রটেকশন। উপদেষ্টারা নিরাপদই থাকবে। তাছাড়া আওয়ামী লীগ আরো ব্যস্ত থাকবে নিজেদেরকে নিয়ে, দলের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্বে রদবদল হবে।
Plan C-র প্রস্তাব বিএনপি লুফে নেয়ারই কথা। তারা ২০০৬ থেকে আজ পর্যন্ত ১৮ বছর ক্ষমতার বাইরে। তারওপর সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়াও তাদের পক্ষে আর সম্ভব নয়। ৫ই আগস্ট নির্বাচন হলে তারা জিততো। কিন্তু এই সাড়ে ৩ মাসে শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা জ্যামিতিক হারে বেড়েছে। ৫ই আগস্ট যেসব আওয়ামী লীগার নৌকায় ভোট দিতেন না, আজ তারা মহা উৎসাহে চোখ বন্ধ করে নৌকায় সিল মারবেন। খেঁটে খাওয়া সাধারণ মানুষও হাসিনাকেই ত্রাতা মনে করবেন। বিএনপি এই সময়েও ভোটারদের মন কাঁড়তে কিছুই করতে পারেনি। তাদের ব্যাঙ্কের বাইরে কোনো ভোট পাবে না। আওয়ামী লীগ অন্তত ১৮০ সিট পেয়ে বিজয়ী হবে। এ অবস্থায় ইউনূস যদি তাদেরকে ইলেকশন রিগিংয়ের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসাতে পারে, তারা সেকাজে ইউনূসের সহযোগী না হওয়ার কোনো কারণ নেই।
আজ সেনাকুঞ্জের অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়ার উপস্থিতি Plan C-এরই ইঙ্গিত দেয়।
তবে Plan C-এরও কিছু ঝুঁকি আছে ইউনূস ও তার উপদেষ্টাদের জন্য। সেগুলো না হয় আরেকদিন আলোচনা করা যাবে। আজ এ পর্যন্তই। শুধু বটমলাইন টানি, এটি মোটামুটি নিশ্চিত যে, ট্রাম্পের ইলেকশন জয় ইউনূসের Plan A-তে পানি ঢেলে দিয়েছে, বাংলাদেশকে সিরিয়া বা আফগানিস্তান হওয়া থেকে ঠেকিয়েছে। ডোনাল্ড জন ট্রাম্প একটি ধন্যবাদ পেতেই পারেন।
#ATeam 20241175