ইজ্জত একবার গেলে তা ফিরে পাওয়া কঠিন। নিজেকে যতোই বোঝানো হোক কাপড় ঠিকঠাকই আছে, কিন্তু হুট করে কেউ বলে বসে, ‘কি ভাই ন্যাংটো হয়ে আছেন কেন? সম্মানের দিক দিয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে এলিট বাহিনী ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী’ কে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সেই পথেই টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কারণটা কী? সেটারই খোঁজ করা যাক।
এটার উত্তর পেতে হলে প্রথমে যেতে হবে গত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ষড়যন্ত্রে। এটিকে আন্দোলন না বলে এখন সরাসরি ষড়যন্ত্র বলার মতো যথেষ্ঠ প্রামাণিক দলিল ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমে বলেছেন যে, ‘এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিলো সরকার পতন। এই উদ্দ্যেশে তারা কয়েকবছর চানখারপুলে একটি বাসা নিয়ে একত্রে থেকেছেন এবং ষড়যন্ত্র করেছেন সরকারের বিরুদ্ধে।’ তার আগেও কয়েকজন সমন্বয়ক একই রকমের কথা বলেছেন যে প্রথম থেকেই তাদের উদ্দেশ্য ছিলো সরকার পতন। হান্নানের বক্তব্যটি আসলে পুরো সিনারিওটাকে উন্মোচন করলো।
এই বক্তব্যগুলো থেকে দু’টি নির্দিষ্ট ব্যাপার প্রমাণিত হয়। প্রথমত, এই সমন্বয়ক গোষ্ঠী জনগণের একটি অংশকে সিরিয়াস প্রতারিত করেছে। ব্যাপারটা অনেকটা টিপিক্যাল সিনেমার গল্পের মতো। বাল্যকালে মুখোশধারী কেউ একজন নায়কের বাবাকে হত্যা করে। পরবর্তীতে একজন তার শত্রুকে মারার জন্য ভুয়া শুভাকাঙ্ক্ষী সেজে নায়ককে প্ররোচিত করে এই বলে যে তার ওই শত্রুই নায়কের বাবার হত্যাকারী। এর বিপরীতে বিভিন্ন ফ্যাব্রিকেটেড প্রমাণও উপস্থাপন করে। নায়কের মিশন একমপ্লিশড হবার পর জানা যায় যে প্ররোচনা প্রদানকারী ব্যক্তিটিই নায়কের বাবার মূল হত্যাকারী। তারপর শুরু হয় নতুন যুদ্ধ। এখানে নায়ক যদি জানতো তার বাবার হত্যাকারী হিসেবে প্রথমে ভুল ব্যক্তিকে দেখানো হয়েছে, তাহলে সে কখনোই প্রথম হত্যাকাণ্ডটি ঘটাতো না। অন্যদিকে তার ভুয়া শুভাকাঙ্ক্ষীই ছিলো তার প্রধান শত্রু। একইভাবে এই সমন্বয়করাও জানতো তাদের বহু বছরের সরকার পতনের প্ল্যান সফল হবার আগ পর্যন্ত সাধারণ মানুষকে তা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দেওয়া চলবে না। এজন্যই তারা প্রথম থেকেই এটা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে যে এই আন্দোলন কখনোই সরকারের এগেইন্সটে না। তাদের যাস্ট কয়েকটা ছাত্রের লাশ প্রয়োজন ছিলো এটাকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে। সেই লাশ তারা যেভাবেই হোক সাপ্লাই দিতে পেরেছে। যারা প্রাণ হারিয়েছে ( যেভাবেই হোক) তারা সমন্বয়কদের উদ্দেশ্য জানতে পারলে হয়তো রাস্তায়ই নামতো না।দ্বিতীয়ত, বিগত কয়েক বছরে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন রাষ্ট্রদ্রোহী কাজে এই গ্রুপটাই জড়িত থাকতে পারে।
এখন, আপাতদৃষ্টিতে এদের মূল উদ্দেশ্য ছিলো সরকার পতন। আসলেই কি তাই? মনে হয় না।এই অল্পবয়সী গোষ্ঠীটি আসলে চায়টা কী? কারণ সরকার পতন করে এরপর তারা কী করবে তা বুঝতে পারলেই তাদের মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। দেশের মানুষের জন্য তাদের অনেক টান থাকলে তাদের বিভিন্ন সংকটে দেখা যেতো। কোভিডে এই গ্রুপটাকে পাওয়া যায় নাই। তারা কোনো জনকল্যাণমূলক কাজে সম্পৃক্ত ছিলো শোনা যায় না। তাহলে আসলে কাহিনিটা কী?
এরা আসলে সাধারণ ব্রেইনওয়াশড তরুণ। তারা যখন দেখলো সরাসরি জঙ্গি কার্যক্রমে অংশ নিয়ে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির কারণে কিছু করা যাচ্ছে না। তখন তারা এই ক্যামোফ্লেজড হবার পন্থা গ্রহণ করে। সম্ভবত শিবির ও অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের ঐকমত্যে পৌছানোর অংশ হিসেবে এই গ্রুপটি তৈরি হয়। এদের মূল উদ্দেশ্য আসলে কয়েকটি ছিলো।
১) যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বদলা নেওয়া।
২) মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি স্তম্ভের বিপরীতে জামাতি প্রোপাগান্ডা দাঁড়া করানো যাতে জামাতের একাত্তরের কর্মকাণ্ডের তীব্রতা সাধারণ মানুষের মাঝে নরমালাইজড হয়ে যায়। অন্যদিকে ১৯৭১’র পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়া।
৩) আওয়ামী লীগ যেহেতু তাদের সকলের মতাদর্শের বিরুদ্ধে একমাত্র শক্তিশালী শত্রু, তাই এদের ক্ষমতার স্থায়িত্ব বাড়াতে আওয়ামী লীগের মতাদর্শের ব্যাপারে জনগণের মনে বিপরীত ন্যারেটিভ দাঁড়া করাতে হবে।
৪) যেহেতু তাদের এই সফল হবার পেছনে অনেকের সাথে হাত মেলাতে হয়েছে। এছাড়া তাদের পুরো পরিকল্পনা ছিলো আমেরিকার ডেমোক্রেটিক সরকারের একটি অংশের তত্ত্বাবধানে। আর ফিল্ড কার্যক্রম পরিচালনা করেছে আইএসআইএর আন্ডারে। তাই এদের নির্দেশে ধর্মকে ব্যবহার করে একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থার কথা বলে প্রকৃত ধর্মীয় শিক্ষায় অশিক্ষিত ভোট ব্যাংকটিকে নিজেদের কাছে টেনে আনা একটি অন্যতম উদ্দেশ্য। যা বাংলাদেশকে চিরস্থায়ী সংঘাতের দিকে ঠেলে দিয়ে এই দুটি বাহিরের গোষ্ঠীরই স্বার্থসিদ্ধি করবে।
৫) নিজস্ব মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করা।
এই উদ্দেশ্যগুলো সম্পূর্ণ সফল করতে হলে তাদের দু’টি ঘটনা ঘটাতে হতো।
প্রথমত, পুলিশ বাহিনীকে মোরালি ভেঙে দেওয়া। যার ফলে মৌলবাদী চেতনা ধারণ করে কিন্তু সাহসের অভাবে রাস্তায় নামতে পারে না, এমন জনগোষ্ঠীর ভয় ভেঙে দিয়ে তাদের খাঁটি জঙ্গিগোষ্ঠীতে পরিণত করা যাবে। এই কাজটি করতে তারা সফল হয়েছে। পুলিশ অপরাধ দমন ও শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার নিমিত্তে হলে বৈধভাবে আঘাত ও নিষ্ক্রিয় করতে পারে। রাষ্ট্র তাদের সেই ক্ষমতা প্রদান করতে পারে। পুলিশকে মানসিকভাবে ভেঙে দেওয়ার ফলে এই নব্য জঙ্গির দল ( যাদের একটা বড় অংশ সুযোগের অভাবে নিরীহ মানুষ সেজে ছিলো) ইচ্ছামতো পুরো দেশে নৈরাজ্য তৈরি করতে পারছে।
দ্বিতীয়ত, আর্মির প্রতি থাকা মানুষের সমীহ ও ভয় নষ্ট করে দেওয়া। আর্মিকে সাধারণ বাহিনীর কাতারে নামিয়ে এনে তাদেরও ধীরে ধীরে মোরালি ভেঙে ফেলা। একই সাথে তাদের এমন অবস্থার দিকে নিয়ে যাওয়া যাতে তাদের জাতিসংঘ মিশন নিয়ে টানাটানি পড়ে যায়। সেনাবাহিনীর ব্যাপারটা আসলে স্পর্শকাতর। এটা ইতোমধ্যে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে সেনাদের ভেতর একটা ছোট দল মৌলবাদী ধ্যানধারণায় বিশ্বাসী। এই দলটির কাছে জাতিসংঘ মিশন থাকার থেকে নিজস্ব মিশন একমপ্লিশড করা বেশি জরুরী। ভয়ংকর ব্যাপার হলো এরা আবার নিজেরা সাধারণ সদস্য সেজে অন্য সবাইকে পথভ্রষ্ট করছে। অর্থাৎ ব্যারাকের বাহিরে পুরো দেশে এই ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠীটি যে কাজটি করছে, ব্যারাকের ভেতরে আর্মিদের মাঝে সেই একই পরিকল্পনায় তারা এগুচ্ছে।
আর্মিকে সাধারণের কাতারে নামিয়ে এনে এদের লাভটা কী? আসলে যে গৃহযুদ্ধের পরিকল্পনা নিয়ে এই মৌলবাদী গোষ্ঠীটি এগুচ্ছে, তা সফল করতে হলে, মানুষের মনে থাকা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতি গর্বের ও আস্থার কনসেপ্টটা ভেঙে দিতে হবে। যার ফলে, মৌলবাদী গোষ্ঠীটি তাদের তুলনামূলক ভীরু সদস্যদের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে নামাতে পারবে। তাদের মনে এমন একটা আরোপিত চেতনা প্রদান করা হবে যে, চাইলেই সেনাবাহিনীর গায়ে হাত তোলা যায়। এটা যে কেউই পারে। যা এখন বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, এবং সম্ভবত এটার চূড়ান্ত রূপ হিসেবে সেনাবাহিনীর উপর পুলিশের মতো ম্যাসকিলিং চালানো হতে পারে।
অন্যদিকে সেনাবাহিনীকে জাতিসংঘের স্যাংশনের দিকে সুচতুরভাবে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এটা সফল হলে এতো বিশাল বাহিনী বহন করা দেশের জন্য কষ্টকর হয়ে যাবে, তা যে সরকারই থাকুক না কেন। তখন এই বাহিনীচ্যুত একটা প্রশিক্ষিত অংশকে মারসেনারি হিসেবে এই মৌলবাদী ও জামাত-শিবির গোষ্ঠীটি ব্যবহার করতে পারবে।
যাদেরকে মৌলবাদী গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে তাদের লাইফ সাপোর্ট দিচ্ছে আসলে সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর একটি অংশ। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়ে এই সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীটি বাংলাদেশে তাদের অপারেশন চালাচ্ছে। এখানে পৃথক তিনটি দলের উদ্দেশ্য ভিন্ন হলেও সেগুলো সফল হলে বাংলাদেশকে একটি নির্দিষ্ট পরিণতিই বহন করতে হবে, এবং তা হলো চিরস্থায়ী নৈরাজ্য।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে একটা ভয়ংকর ফাঁদের ভেতর এনে ফেলা হয়েছে। যে পশ্চিম পাকিস্তান বাঙালিদের সেনাবাহিনীর উঁচু পদে কখনো নিয়োগ দিতো না, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতো। পুনরায় বেশ তীব্রভাবে তাদেরই অশুভ ছায়ায় পড়েছে বাহিনীটি। এটা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, এই বাহিনীর সিংহভাগ সদস্যই দেশপ্রেমিক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী। তাঁরা কিছু বিশ্বাসঘাতকের বুনে চলা ভয়ংকর ফাঁদ থেকে বের হয়ে এসে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি পুনরায় ফিরিয়ে আনতে পারবে কিনা তা হয়তো সময়ই বলে দিবে। কিন্তু এদেশের বেশিরভাগ জনগণই যে এই দেশপ্রেমিক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সদস্যদের পাশে থাকবে ১৯৭১ সালের মতোই, তা শতভাগ নিশ্চিত।
#ATeam 20241185