ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তার সংস্কার তত্ত্ব
ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তার সংস্কার তত্ত্ব

সেই ২০০৬ সাল থেকে ড. ইউনূস বলে আসছেন, দেশের রাজনীতিবিদরা অসৎ, রাজনৈতিক দলগুলো দেশকে ধ্বংস করে ফেলেছে। তিনি দেশের সংস্কার করতে চান। এই ২০২৪ সালে এসেও তার মুখে সেই সংস্কারেরই বুলি। সংস্কারের সময়সীমা নিয়ে তাকে প্রশ্ন করা হয়েছে। সে প্রশ্নের উত্তরও তিনি বিভিন্ন সময়ে দিয়েছেন। কখনো ৫ বছর, কখনো ৪ বছর, কখনো ছাত্রজনতা যতোদিন চায়। এর মধ্যে আবার অনির্দিষ্টকালের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ রাখার জন্য আইনও তৈরি হচ্ছে। তবে এতো সব আলোচনার মধ্যেও তিনি কখনো পরিষ্কার করে বলেন নি, সংস্কার বলতে তিনি আসলে কী বুঝাতে চেয়েছেন। কোন কোন বিষয়ে তিনি সংস্কার করবেন? সংস্কারের মাত্রা কী হবে ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর কেউই জানে না।

আমরা চেষ্টা করবো ড. ইউনূসের গত সাড়ে তিন মাসের কাজকর্ম থেকে এই সংস্কার বিষয়ক প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বুঝা এতো সহজ নয়। তিনি খুবই কম্প্লিকেটেড মানুষ। তার কাজের গতিবিধি বুঝতে হলে তার কিছু তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক বৈশিষ্ট্য মাথায় রাখতে হবে। যেমন,

ক) তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলেছিলেন
খ) তিনি অধার্মিক মানুষ, ধর্ম দিয়ে মানুষকে বিচার করেন না
গ) তিনি প্রচণ্ডরকম স্বার্থপর মানুষ, স্বার্থের জন্য যে কোনো কিছু করতে পারেন
ঘ) তিনি প্রচণ্ডরকম প্রতিহিংসাপরায়ণ মানুষ
ঙ) তিনি টাকা পয়সার ব্যাপারগুলো খুব ভালো বুঝেন, ফাঁকফোঁকর সব তার নখদর্পণে

তার এই বৈশিষ্ট্যগুলো তার কাজকর্মের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে দেয়। আমরা এবার সংস্কারের কয়েকটি ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা করবো। এবং সেসব ক্ষেত্রে তিনি কী কী কাজ করেছেন এবং করছেন, তা বুঝার চেষ্টা করবো।

১) অর্থনৈতিক সংস্কার

ড. ইউনূস সবচেয়ে প্রকাশ্য সংস্কার করেছেন দেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে। তিনি অনেকবারই বলে থাকেন, আমাদের যুবসমাজকে চাকরি করতে হবে না। তাদেরকে উদ্যোক্তা হতে হবে। অনেকে বলে থাকেন, উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য যে ঋণ দরকার, ড. ইউনূস সেই ঋণের ব্যবসা করতেই এই সাজেশন দিয়েছেন। আমার তা মনে হয় না। তিনি খোলা মনেই কথাটি বলেছেন। গ্রামীণ থেকেই ঋণ নিতে হবে, এমন নয়। এবং তার কথার পরিসর আরো অনেক বড়ো। তিনি মূলত চিন্তাচেতনার প্রসার বাড়াতে চেয়েছেন। এ কারণেই তিনি ক্ষমতা গ্রহণ থেকে আজ পর্যন্ত এক এক করে বাংলাদেশের শিল্প কারখানাগুলো ধ্বংস করে ফেলছেন। বেশিরভাগই আগুন দিয়ে পুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। শ্রমিকরা স্ট্রাইক করলে কারখানা বন্ধ থাকে শুধু স্ট্রাইকের দিনগুলো। কারখানা ভাঙচুর করলে তার অংশবিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মোটামুটি অল্প সময়ের মধ্যেই আবার কারখানা চালু করা যায়। কিন্তু কারখানায় যদি আগুন দেয়া হয়, তাহলে সেটি পুঁড়ে একেবারে শেষ। রিকভার করা প্রায় অসম্ভব। কিছু কিছু কারখানায় কয়েক দফা আগুন দিয়ে নিশ্চিত করা হয়েছে যে, সেগুলো আর কখনোই চালু করা সম্ভব হবে না।

এর বাইরে রিক্সা উঠিয়ে দেয়া, শিক্ষকদের জোরপূর্বক পদত্যাগ করানো, ব্যবসা-বাণিজ্য দখলজাতীয় যতো কাজ করা হয়েছে, সবকিছুরই উদ্দেশ্য এক। তাহলো মানুষকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা। কিভাবে? একটি কারখানা যখন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়, তখন তার শ্রমিকরা অন্য কারখানায় কাজ খুঁজবে। কিন্তু, একের পর এক যখন কারখানা বন্ধ হতে থাকবে, তখন নিশ্চিতভাবেই তারা বেকার হবে, চাকরিচ্যুত হবে। অর্থাৎ চাকর নয়, উদ্যোক্তার অর্ধেক বাস্তবায়ন শেষ। যারা বেকার হবে, তাদেরকেও তো বাঁচতে হবে। কেউ কেউ চুরি ছিনতাই করবে। তবে সেগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। অধিকাংশ মানুষেরই সে সাহস নেই। একটা পর্যায়ে গিয়ে তারা নিজেরা কলকারখানা না করুক, অন্তত গবাদিপশু, হাসমুরগি পালনজাতীয় ছোট উদ্যোক্তা হিসেবে আবির্ভূত হতে বাধ্য হবে। এভাবেই চলছে পুরো দেশের অর্থনৈতিক সংস্কার।

২) ধর্মীয় সংস্কার

বাংলাদেশের মানুষের একটি ফাঁপা গর্বের বিষয় হলো তারা ধর্মভীরু। ড. ইউনূস ধার্মিক নন। তিনি দেশের মানুষের এই ধর্মভীরুতা পছন্দ করেন না। সংস্কার করতে চান। পছন্দ না করার কারণ হলো দেশের মানুষ জন নাইভ ও অশিক্ষিত। তারা ধর্ম সম্পর্কে নিজেরা পড়াশুনা করে না, তেমন কিছু জানে না বললেই চলে। তারা ধর্ম মনে করে হুজুরদের ওয়াজ শুনে। আগে ময়দানে গিয়ে শুনতো। এখন ইন্টারনেটের কল্যাণে ইউটিউব ফেসবুকে শোনে। এভাবে শুনে শুনে তারা আসলে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যার কাস্টোমারে পরিণত হয়। তাদের ধর্মভীরুতা থাকে কাগজে-কলমে। ওয়াজের কল্যাণে তারা হিংস্র হয়ে যায়। ধর্মের অজুহাতে অন্য মানুষকে নির্দ্বিধায় খুন করে ফেলতে তাদের হাত কাঁপে না। হিন্দু হোক, ইহুদী-নাসারা হোক, অন্যধর্মের বা নাস্তিকদেরকে গণহত্যা করে খুন করে ফেললেই পৃথিবীতে আল্লাহর আইন কায়েম হবে, এটি তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে।

ধর্মভীরু বাঙালির এই ঘৃণার বিশ্বাস এতো শক্তিশালী যে, আপনি আল্লাহর কুরআন থেকে আয়াত এনে দেখালেও তাদেরকে সেখান থেকে সরাতে পারবেন না। “Let there be no compulsion in religion …” এরকম সোজাসাপ্টা বক্তব্য দিয়েও তাদেরকে টলাতে পারবেন না। তারা মসজিদে গিয়ে উঠবস করলেও নামাজ কায়েম করে না, ইফতার পার্টি করলেও রোজা রাখে না, অন্যের হক্ব মেরে খায়, কিন্তু টপিকটা “মুসলমান” সম্পর্কিত হলে তাদের জিহাদী ঈমান খাড়িয়ে যায়।

এ অবস্থা থেকে উত্তোরণের উপায় কী? উত্তোরণের উপায় আসলে নেই বললেই চলে। আপনাকে প্রথমেই ওয়াজ-মাহফিল বন্ধ করতে হবে। সেটি সম্ভব না। আপনাকে মসজিদ থেকে দানবাক্স উঠিয়ে দিতে হবে। সেটি সম্ভব না। আপনাকে মাদ্রাসাগুলো একদমই সীমিত করে দিতে হবে, যাতে অর্থনৈতিকভাবে অনুৎপাদনশীল একটি জনগোষ্ঠী দেশের বোঝা হয়ে বড় হয়ে না ওঠে। সেটিও সম্ভব না। ফিসাবিলিল্লাহ বোর্ডিং অনেকেরই রাজপ্রাসাদের মূলধন। দেশের ধর্মভীরু আমজনতা নামাজ-রোজা না করে দানবাক্স পূরন করে আর হিন্দু পিটিয়ে জান্নাতে যেতে চায়। জান্নাতের আবার বিভিন্ন স্তর আছে। সবাই-ই চায় জান্নাতুল ফেরদাউস। হুরের স্বপ্নে বিভোর থাকে। ৭০ গুণ সওয়াবের ওয়াজ মেনে টাকা পয়সা ঢালতে থাকে।

ড. ইউনূস অবশ্যই এ দুরবস্থার সংস্কার চান। তিনি যেটি করেছেন, তাহলো এই ধর্ম ব্যবসায়ীদেরকে একেবারেই স্বাধীনতা দিয়ে দিয়েছেন। তারা এখন যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারে। ইচ্ছা হলেই দলবল নিয়ে হিন্দু পেটাতে পারে, মুরতাদ ট্যাগ দিয়ে মুসলমানদেরকে খুন করতে পারে, ব্যবসায়িক মনোপলির জন্য মাজার ভাঙতে পারে। আন্তঃপীর আত্মকলহ তো সর্বজনীন। ইউনূস দেশের ধর্মভীরু মানুষদেরকে সুযোগ করে দিয়েছেন এই ধর্মব্যবসায়ীদের প্রকৃত স্বরূপ চেনানোর। তাদেরকে যদি বলা হতো আফগানিস্তান এভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে, অতীতের গৌরবোজ্জ্বল সিরিয়া এদের কারণে আজ পোঁড়া বালির দেশ, তাহলে তারা বিশ্বাস করবে না, গালগল্প মনে করবে। ওয়াজের বয়ান তাদের মর্মে মর্মে গেঁথে আছে। কিন্তু যখন এরা চোখের সামনে এদের তাণ্ডব দেখবে, একসময় বুঝতে পারবে এরা কেন ঘষে। এই সংস্কারেও সময় লাগবে। কেউ গিয়ে হিন্দুর বাড়িঘর লুট করে আসবে। একসময় দেখা যাবে তার নিজের মেয়েসন্তানকেও মেয়ে হয়ে কলেজে যাওয়ার অপরাধে আরেক গ্রুপ মেরে আলুভর্তা বানিয়ে দিয়েছে। তখন নিজের গায়ে লাগবে। মার খেতে খেতে শিখবে। মার দেখতে দেখতে না শিখুক।

৩) রাজনৈতিক সংস্কার

অনেকেই মনে করেন, রাজনৈতিক সংস্কারই ড. ইউনূসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। আমার সেটা মনে হয় না। তাই এটিকে তালিকার ৩ নম্বরে রাখলাম। ড. ইউনূস পেশাদার রাজনীতিবিদ নন। তার কোনো সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শ নেই যে, সে আদর্শকে স্থাপনের জন্য কাজ করবেন। তবে তার অতীত দেখে আমার মনে হয়, তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর শ্রদ্ধাশীল। এখন যতোই রিসেট বাটন চাপুন না কেন, এটি তার মৌলিক বৈশিষ্ট্য নয়। আওয়ামী লীগের সাথেও তার রাজনৈতিক বিরোধ নেই। বিরোধ আছে ক্ষমতা এবং অর্থের।

ড. ইউনূসের মতো বিচক্ষণ মানুষ নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, বাংলাদেশের শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক দলই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ধারণ করে। সেটি আওয়ামী লীগ। জামায়াত তো স্বাধীন বাংলাদেশই চায় নি। আর বিএনপির মূল কাজ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে কলুষিত করা। কিন্তু সেই আওয়ামী লীগের মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কিছু ক্ষমতাশালী এলিমেন্ট দলটিকে আদর্শবিচ্যুত করতে কাজ করছে। তাদের অত্যাচারের কারণে আওয়ামী লীগের ওপর মানুষ বিরক্ত। সেই বিরক্তি গিয়ে পড়ছে বঙ্গবন্ধুর ওপর, মুক্তিযুদ্ধের ওপর, মুক্তিসংশ্লিষ্ট সবকিছুর ওপর।

ড. ইউনূস অবশ্যই খেয়াল করেছেন, শেখ হাসিনা দেশের মানুষের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেও তাদের মন পাচ্ছেন না। নিজদলের নীতিহীন সুবিধাবাদী নেতা ও বিপক্ষের ক্রমাগত প্রোপাগান্ডার কারণে বাংলাদেশের মানুষ শেখ হাসিনার ওপর বিরক্ত। ইউনূস নিজেও চরম বিরক্ত। তবে সেটি রাজনৈতিক কারণে নয়, ক্ষমতা ও আর্থিক কারণে। ড. ইউনূসকে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত করতে শেখ হাসিনার অবদান অনেক। যাহোক, আলোচনায় ফিরে আসি। ইউনূসের রাজনৈতিক সংস্কারের মূল উদ্দেশ্য বাংলাদেশের মানুষকে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে আনা, দেশের শত্রুমিত্র চিনতে সাহায্য করা। তিনি এজন্য রিভার্স গেমের আশ্রয় নিয়েছেন। ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর পুঁড়িয়ে প্রথম ধাক্কাটি দিয়েছেন। এরপর রিসেট বাটন চেপে বলে দিয়েছেন অতীত শেষ, মুক্তিযুদ্ধ শেষ। বঙ্গবন্ধু শেষ। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙেছেন, ভাস্কর্যের মাথায় প্রস্রাব করেছেন। এভাবে ধাক্কা না দিলে বাঙালি তাদের ভুল বুঝতে পারতো না। ড. ইউনূস সফল। আজ ৪ মাসেরও কম সময়ের মাথায় বাঙালি এখন শেখ হাসিনাকে চায়। দেশকে গৃহযুদ্ধের মধ্যে ঠেলে দিয়ে ইউনূস দেশবাসীকে মুক্তিযুদ্ধের ফিলিং দিচ্ছেন। আরো কিছু দিনের মধ্যেই দেশের মানুষের রাজনৈতিক সংস্কার অনেকটাই হয়ে যাবে, তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিশুদ্ধ মানুষ হবে।

আওয়ামী লীগের আরো একটি সমস্যারও সমাধান করে ফেলছেন ইউনূস। আওয়ামী লীগে যেসব সুযোগ-সন্ধানী নেতা জেঁকে বসেছিলেন, তারা এখন পলাতক। কোনোরকম দায়িত্বই নিচ্ছেন না তারা। আওয়ামী লীগের সমর্থকরা গত ১৫ বছরে ভয়ে এদেরকে কিছু বলতে সাহস পায় নি। কিন্তু এখন এরা সোচ্চার। আওয়ামী লীগের এরকম আবর্জনা নেতারাও ভবিষ্যতে দলের নেতৃত্বে আসতে পারবে না। শুধু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আছে যাদের, তারাই নেতৃত্বে আসতে হবে। এমন সূচারুভাবে রাজনৈতিক সংস্কার করা একমাত্র মেটিকুলাস ইউনূসের পক্ষেই সম্ভব।

৪) শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কার

গত ১৫ বছর বাংলাদেশে অন্যতম বড়ো সমস্যা ছিলো শিক্ষা। শিক্ষকরা ঠিকমতো পড়াতেন না। কারিকুলাম ছিলো উটকো। ছেলেমেয়েরা শিখতো না। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রীরা এমন নিয়ম করে রেখেছিলেন যে পরীক্ষার খাতায় কিছু লিখলেই এ প্লাস।

ড. ইউনূস ক্ষমতায় বসেই প্রথমে শিক্ষকদেরকে মবের মাধ্যমে গণহারে পদত্যাগ করিয়েছেন। এরপর বর্তমানে চলছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর। এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা গিয়ে অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভেঙ্গে দিয়ে আসছে এবং ভাইস ভার্সা, যাতে কোনোরকম মায়াদয়া না দেখিয়ে মেটিকুলাসলি ভাঙ্গা যায়। ভাঙ্গা প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র উড়ছে রাস্তায়, চেয়ার-টেবিল, কম্পিউটার, সোফা, প্রিন্টার, বদনাসহ যা যা নেয়া সম্ভব, সবকিছুই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অবধারিতভাবে সব কাচ, বড়ো বড়ো ডেস্ক, যা সাথে নেয়া সম্ভব না, তা বেশ কৌশলের সাথে ভাঙ্গা হচ্ছে। এভাবে একটি ভাঙ্গা প্রতিষ্ঠানে আবার পড়ালেখা সীমিত মাত্রায় চালু করতেও কমসে কম ৬ মাস সময় লেগে যাবে।

এখানে সংস্কারটা কী করলেন? হ্যাঁ, সেটি বুঝতে পারা একটু কঠিন বটে। ইউনূস কমপ্লিকেটেড মানুষ। তবে একদম কঠিনও না। যেমন ধরেন, কোনো ছেলে কলেজ ভেঙ্গে একটি কম্পিউটার নিয়ে গেলো। সে দেখা যাচ্ছে, কম্পিউটার ব্যবহার করে পড়াশুনা শিখছে। আগে হয়তো টাকার অভাবে কিনতেই পারে নি। কারো হয়তো ভালো চেয়ার ছিলো না। এখন চেয়ার নিয়ে এসেছে। তাতে বসে পড়াশুনা করবে। কারো হয়তো বাসায় টেবিল ফ্যান ছিলো না। সে টেবিল ফ্যান নিয়ে এসেছে। গরমের মধ্যেও বাতাসে পড়তে পারবে, যদি আদানীর বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু থাকে আর কী! তবে সেটি কথা নয়। কথা হলো, ইউনূস শিক্ষাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্রছাত্রীদের একেবারে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছেন। আগে যারা স্কুল কলেজে যেতে চাইতো না, শিক্ষা নিতে চাইতো না, এখন স্কুল কলেজই খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে তাদের কাছে চলে এসেছে। জাতি এবার শিক্ষিত হওয়ার প্রক্রিয়া থেকে চাইলেও পালাতে পারবে না!

৫) সাংস্কৃতিক সংস্কার

গত ১৫ বছরই নয়, গত অন্তত ৩০ বছর ধরেই আমরা শুনে আসছি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কথা। বাংলা ছবি চলে না, বাঙালির নাচ টিভিতে কেউ দেখতে চায় না, সবাই হিন্দি চায়, রেডিওতেও হিন্দি গান চলে, এসব অভিযোগ করে আসছে অনেকেই। কিন্তু কোনো সমাধান হয় নি।

ড. ইউনূস এবার একদম সংস্কৃতির মাঝখানে আমাদেরকে ছেড়ে দিয়েছেন। হিন্দী কা বাত দূরে থাক একেবারে পাকিস্তানী মুজরা, কাওয়ালী আর কী সব সংস্কৃতি সবকিছু একদম তড়িৎ গতিতে আমদানী করে এনেছেন। আজ যেমন আতিফ আসলামের গান শুনতে বাঙালি টিকেটের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। টিকেট না পাওয়ায় হল্লা করে সেনাবাহিনীর লাঠির বাড়ি খেয়েছে। তবুও তাদের আগ্রহে ভাটা পড়ে নি। নামকরা নায়িকারা শো-রুম উদ্বোধনে গিয়ে জিহাদী জনতার ধাওয়া খেয়ে ফিরে আসছেন; নিজেরা বেকার জীবন কাটাচ্ছেন, কিন্তু ঘন্টা দুয়েক সময় মেকআপে ব্যয় করেও আতিফ ইসলামের কনসার্টে যাচ্ছেন। দেশের এক অংশের মানুষ খেয়ে-না খেয়ে দিনপাত করছে। আবার অন্য অংশের হাতে অঢেল টাকা। যাদের অঢেল নেই, তারাও পিয়ার প্রেসারে আতিফ ইসলাম দেখতে যাচ্ছে।

ড. ইউনূস সাংস্কৃতিক উপদেষ্টা হিসেবে এমন একজনকে নিয়োগ দিয়েছেন, যে বাংলা নাটক সিনেমার সংস্কৃতিকে অনেক আগেই লিটনের ফ্ল্যাট বানিয়ে ফেলেছে।

এখন কথা হলো, এখানে ইউনূসের চালটা কী? ধরেন আজ যারা পিয়ার প্রেসারে আতিফ ইসলামকে দেখতে গিয়ে আর্মির পিটানি খেয়ে এলো, তারা কাল হোক পরশু হোক চিন্তা করতে বাধ্য হবে, “ইজ ইট ওয়ার্থ ইট?” মানুষের মধ্যে নিষিদ্ধের প্রতি আকর্ষণ থাকে। যা পায় না, তার প্রতি আকর্ষণ থাকে। পাওয়ার পর আকর্ষণ কমে। বিশেষ করে ইন্ট্রিন্সিক কোয়ালিটি না থাকলে মানুষ ভোগের পর পণ্যবিস্মৃত হয়। সেটি শারীরিক সম্ভোগও হতে পারে, আবার সংস্কৃতিও। আপনারা দেখে থাকবেন, কোক স্টুডিও বা এইসব আল্ট্রা মডার্ন প্রজন্ম বাউল গান শুনে এখন খুশিতে পারলে হেগেমুতে একাকার করে দেয়। তারা অবশ্য অরিজিনাল গানের মধ্যে একটু খাঁজখুঁজ ঢুকায়। তা না হলে আবার অত্যাধুনিকতা রক্ষা হয় না বলে। কিন্তু এই গানগুলো সিলেকশনের মূল কারণ গানগুলো কালজয়ী। তারা অনেক হাবিজাবি ট্রাই করে দেখেছে, কাজ হয় নি, জনপ্রিয়তা পেতে ফিরতে হয়েছে শিঁকড়ের কাছে।

আতিফ ইসলাম আর কাওয়ালী ট্রিটমেন্টের পর বাঙালিও নিশ্চয়ই বাধ্য হবে নিজস্ব সংস্কৃতিতে ফিরতে। তখন বুঝতে পারবে “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি”র আবেগ, অর্থ, গভীরতা।

৬) বাক স্বাধীনতার সংস্কার

গত ১৫ বছর একটি কান ঝালাপালা করা অভিযোগ ছিলো দেশে বাক-স্বাধীনতা নেই। কান ঝালাপালা এজন্য বলছি যে, কথাটি আমরা প্রতিদিনই কমবেশি শুনতাম টেলিভিশনের টক শোগুলোতে। অতিথিরা ক্রমাগত বলে যেতেন, তারা কথা বলতে পারছেন না। কিন্তু কোনো কথাই বাকি রাখতেন না এবং এজন্য তাদেরকে মোটাদাগে কোনোরকম নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীনও হতে হয় নি। বিচ্ছিন্নভাবে এখানে ওখানে সাংবাদিকরা মামলা খেয়েছেন, দুয়েকজন সাংবাদিক নির্যাতিত হয়েছেন, যার মধ্যে আমলাদের পাওয়ার প্র‍্যাকটিসের মতো বিষয়ই বেশি ছিলো। সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার। মাহফুজ আনাম নিজমুখে স্বীকার করেছেন ওয়ান ইলেভেনের সময় তারা ফ্যাব্রিকেটেড নিউজ করেছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিরুদ্ধে। তবে ওয়ান ইলেভেনই নয়, আওয়ামী লীগ শাসনামলের পুরোটা সময়ই তারা আওয়ামী লীগের সমালোচনায় মুখর ছিলেন। সে সমালোচনাকে অবশ্য সমালোচনা বললে ভুল হবে, তাদের বেশিরভাগ সমালোচনাই ছিলো প্রোপাগান্ডা এবং সরকার পতনের মেটিকুলাস পরিকল্পনার অংশ। তবুও মতিউর রহমান বা মাহফুজ আনামকে কখনো জেলে যেতে হয় নি। প্রথম আলোর অনুষ্ঠানে আবরার নামে নবম শ্রেণির একটি ছাত্র কর্তৃপক্ষের অবহেলায় ইলেকট্রিক শকে মারা গেলেও প্রথম আলোর কাউকে জেলহাজতে যেতে হয় নি।

বাংলাদেশ অবশ্যই বাক-স্বাধীনতার স্বর্গরাজ্য নয়। শেখ হাসিনার নামে কটুক্তি করে অনেক অতি উৎসাহী নেতার কারণে কাউকে কাউকে মামলা খেতে হয়েছে। আবার শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দিয়েও অগণিত মানুষ পুরোপুরি পার পেয়ে গেছে।

ড. ইউনূস তার বাক-স্বাধীনতা সংস্কারের অংশ হিসেবে প্রথমেই বাক-স্বাধীনতার বার এতো নিচে নামিয়ে এনেছেন যে, তাকে পুরোপুরি জিরো টলারেন্স বলা যায়। ইউনূস দেশ চালাতে পারছেন না, সংবিধানে তার কোনো ভিত্তি নেই, এই সহজ সরল সত্য কথা বলার কারণে ম্যাজিস্ট্রেট ঊর্মির মতো লোককে চাকুরিচ্যুত করে দিয়েছেন। বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিকের অণ্ডকোষ ফাটিয়ে দিয়েছেন। পুলিশ প্রশাসনে জামায়াত বিএনপির লোককে পদায়ন করে ৭১-এ যেভাবে “মুক্তি” খোঁজা হতো, এখন সেভাবে “আওয়ামী লীগ” খোঁজা হচ্ছে। ফেসবুকে কারো নামে ফেইক স্ট্যাটাস দিয়েও তাকে গণপিটুনির টার্গেট করা হচ্ছে। এক কলমের খোঁচায় কোনোরকম আইন-আদালত ছাড়া প্রায় শ’দুয়েক প্রথম সারির সাংবাদিকের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করেছেন।

সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, ইউনূস নিজেই বলেছেন, আপনারা এখন মন খুলে সমালোচনা করুন। কিন্তু কেউ মন খুলতে গেলেই ইউনূস তাকে গিলে ফেলছেন। বাক-স্বাধীনতার লিমিট এবং অতীতে মানুষ যে লাগামছাড়া বাক-স্বাধীনতা ভোগ করেছে, সেই শিক্ষাটি ইউনূস জাতিকে ইতোমধ্যেই কমবেশি দিয়ে ফেলেছেন। তবে সবচেয়ে বড়ো শিক্ষাটি দিয়েছেন প্রথম আলো আর ডেইলি স্টারকে। একটি প্যারোডি আছে,

বাংলাদেশের যতো গুজব, যতো অকল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে আলু, অর্ধেক ডেইলি স্টার

সেই আলুস্টারকে ইউনূস ঘোল খাইয়ে ছেড়েছেন। দিল্লীর দাসত্ব থেকে মুক্তির প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে আওয়ামী লীগকে উৎখাত করলো যে আলু-স্টার, আজ তাদেরকেই ইউনূসের লোকজন দিল্লীর এজেন্ট হিসেবে উৎখাত করতে চায়। আমি মনে করি, এরপর আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসবে, মতি-মাহফুজরা তখন শেখ হাসিনার পা ধরে ক্ষমা চেয়ে তওবা করবে অতীতের সব অপকর্মের জন্য।

পরিশেষ

উপরের আলোচনা থেকে আপনারা কী বুঝলেন? আমি যা বুঝলাম, তাহলো ইউনূস মানুষকে ভেতর থেকে শুদ্ধ করতে চাইছেন। মনের সংস্কারই আসল সংস্কার। মানুষকে আঘাত দিয়ে হলেও, চোখে আঙুল দিয়ে হলেও তিনি বুঝিয়ে দিচ্ছেন মানুষ কী ভুল করছে, কী ভুল করেছে। মানুষ যদি এভাবে নিজের ভুল বুঝতে পারে, তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সব সংস্কার হয়ে যাবে, ক্ষেত্র রাজনৈতিক হোক, ধর্মীয় বা অর্থনৈতিক, কিংবা সাংস্কৃতিক। তখন কোনো সরকারকেই গলাবাজি করতে হবে না, চেতনা ব্যবসা করতে হবে না, ইউনূসের সংস্কার শেষে আমরা অতি অবশ্যই নিজ থেকেই আবার গাইবো, “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি”।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *